আবার এমন বরফ মিলবে তো?

এ বছর তুষারপাতের সাক্ষী হতে পেরেছে দার্জিলিং শহর। কিন্তু তা ব্যতিক্রমীই। নির্বিচার গাছ কাটা আর পরিবেশ দূষণই দ্রুত চরিত্র বদলে দিচ্ছে শৈলশহরের চেনা ছবির। লিখছেন কিশোর সাহাএক দিন দুপুর থেকে পরের দিন বেলা প্রায় ১১টা অবধি ওই রাস্তা হেঁটে পাড়ি দিতে হয়েছিল সকলকে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৬ জানুয়ারি ২০১৯ ০৫:৪১
Share:

হিম-চাদর: এগারো বছর পর তুষারপাত দার্জিলিংয়ে। —নিজস্ব চিত্র।

পুরু বরফে ঢেকে গিয়েছিল লাভা-লোলেগাঁওয়ের রাস্তা। যত দূর চোখ যায়, পাইনের বনের ডালে-পাতায় সাদা কুচি বরফের ছোঁয়া। বাতাসিয়া লুপ থেকে দার্জিলিং অবধি রাস্তায় এতটাই পুরু বরফের চাদর যে, গাড়ি চলাচল বন্ধ। এক দিন দুপুর থেকে পরের দিন বেলা প্রায় ১১টা অবধি ওই রাস্তা হেঁটে পাড়ি দিতে হয়েছিল সকলকে।

Advertisement

এগারো বছর আগে এমন দৃশ্য দেখে উচ্ছ্বাসে ভেসে গিয়েছিল পাহাড়-সমতল। তার পর থেকে অত ভারী তুষারপাত আজও হয়নি দার্জিলিঙে। খুচখাচ বরফ পড়েছে কখনও টাইগার হিলে বা জলাপাহাড়ের মতো জায়গায়। তিন্তু ফি-বছর সান্দাকফু-ফালুটে ভারী তুষারপাত হয়। যেমন হয় ছাঙ্গু-নাথুলা, লাচুং-লাচেনে।

তা হলে দার্জিলিং শহরের প্রতি প্রকৃতি কেন বিরূপ হয়ে পড়ছে? কেনই-বা কালিম্পংয়ের লাভা, লোলেগাঁও আগের মতো বরফের সাদা চাদরে ঢেকে যায় না শীতকালে? কেনই-বা শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, মালদহ আগের মতো শীত উপভোগ করতে পারছে না? এ সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন পাহাড়-সমতলের অনেকেই।

Advertisement

হিমালয়ান নেচার অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার ফাউন্ডেশনের মুখপাত্র অনিমেষ বসুর মতে, ‘‘পাহাড়ে গাছের সংখ্যা অনেক জায়গায় কমে গিয়েছে। সবুজ বন কমছে। সমতলের মতো পাহাড়ি শহরগুলিতেও কংক্রিটের বন বাড়ছে। এ সবের প্রভাব জলবায়ুর উপরে পড়বেই।’’

দার্জিলিং, কালিম্পং, কার্শিয়াংয়ের বেশ কিছু এলাকায় চোরাগোপ্তা গাছ কাটা চলছে বলেই অভিযোগ রয়েছে। বিশেষত, পাহাড়ে লাগাতার বন্‌ধ আর আন্দোলনের সময়ে বনকর্মী, পুলিশ-প্রশাসনের পক্ষে বনাঞ্চলে তেমন ভাবে নজরদারি করাও সম্ভব হয়নি বা হয় না বলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের একাংশ মানেন। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ডাউহিল, লাভা, লোলেগাঁও, সিঞ্চল বনাঞ্চলের বহু গাছ কাটা হচ্ছে।

অবশ্য গাছ কাটার অভিযোগ পাহাড়-সমতল সর্বত্রই রয়েছে। কোথাও উন্নয়নের নামে, কোথাও রাস্তা চওড়া করার নামে দেদার গাছ কাটা হয়। আবার কোথাও কাঠচোরেদের দাপটে বন ক্রমশ ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। তাতেই উষ্ণায়ন হচ্ছে বলে মনে করছেন অনেকেই। পরিবেশকর্মী তথা আইনজীবী সুভাষ দত্ত উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকায় একাধিকবার সমীক্ষা চালিয়ে দেখেছেন, কোথাও নদিখাত ভরাট করা হচ্ছে। আবার কোথাও বনাঞ্চলের কাঠ চুরি হয়ে যাচ্ছে দিনেদুপুরে।

ইতিমধ্যেই পরিবেশ আদালতের নজরে উত্তরবঙ্গের পরিবেশের বিপন্নতার বিষয়টি পৌঁছে দিয়েছেন সুভাষ দত্ত। তিনি বলেন, ‘‘উত্তরবঙ্গের পাহাড়-সমতলের পরিবেশ আগের মতো নেই। গ্রীষ্মকালে কলকাতাকে ছাপিয়ে যায় এখন। শীতে তেমন ঠান্ডা বেশি দিন থাকে না। এটা নিয়ে সরকারি পর্যায়ে বিশদ সমীক্ষা করে পদক্ষেপ করা দরকার। না হলে কলকাতা, শিলিগুড়ি, মালদহ, কোচবিহার, পুরুলিয়ার আবহাওয়ার মধ্যে তেমন ফারাক থাকবে না।’’

কোচবিহার হেরিটেজ সোসাইটির মুখপাত্র অরূপজ্যোতি মজুমদারের বক্তব্য, ‘‘যে ভাবেই হোক যথেচ্ছ ফ্ল্যাট, আবাসন তৈরিতে সীমারেখা টানতে হবে। যেখানে-সেখানে গাছপালা কেটে বহুতল বাড়ি তৈরির আগে পরিবেশ সমীক্ষা করানো জরুরি।’’ একই ভাবে আলিপুরদুয়ার নেচার ক্লাবের কর্ণধার অমল দত্তও মনে করে, ডুয়ার্সের বনাঞ্চল লাগোয়া এলাকায় রিসর্ট, হোটেল তৈরির আগে এলাকার পরিবেশের উপর কতটা প্রভাব পড়বে, তা খোঁজ নেওয়া জরুরি। তিনি বলেন, ‘‘লাটাগুড়ি থেকে গরুমারা, মূর্তি বনাঞ্চলের মধ্যে জঙ্গল কেটে বহুতল হোটেল, রিসর্ট তৈরি হয়েছে। গাছ কাটলে পাল্টা গাছ রোপণ করাকে বাধ্যতামূলক করতে হবে।’’ শিলিগুড়ির পরিবেশকর্মী সুজিত রাহা বলেন, ‘‘বছরদশেক আগে দার্জিলিং, কালিম্পং, কার্শিয়াংয়ের রাস্তায় কিছুটা এগোলেই সবুজ চোখে পড়ত। এখন কিছু কিছু জায়গায় বেশ ফাঁকা মনে হয়। তবে, ঘুমের কাছে সবুজ পাইন বনটা এখনও আছে। লাভা-লোলেগাঁওয়ের রাস্তার বন কিছুটা ফাঁকা হয়েছে। রাস্তা সম্প্রসারণের জন্য লাভা থেকে ডুয়ার্স রুটে বহু গাছও কাটা হয়েছে। নতুন করে বনসৃজন না করলে আবহাওয়া আগের চেয়ে গরম হবেই। তখন বরফের চাদরে মোড়া লাবা-লোলেগাঁও দেখার সাধ মিটবে কী করে!’’ তাঁর আক্ষেপ, শিলিগুড়ির কাছে বৈকুণ্ঠপুর বনাঞ্চল ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে যাওয়ায় শহরবাসীকে নানা সমস্যা পড়তে হচ্ছে। সিকিমের ছাঙ্গু-নাথুলায় ফি-বছর ভারী তুষারপাত হয়ে থাকে। ওই এলাকা দার্জিলিংয়ের চেয়ে অনেক উঁচু। কেন্দ্রীয় আবহাওয়া মন্ত্রকের সিকিম শাখার অধিকর্তা গোপীনাথ রাহা বলেন, ‘‘শীতে দার্জিলিং-সিকিমের উঁচু এলাকা, মানে সান্দাকফু, ছাঙ্গু-নাথুলা, লাচুং-লাচেনে বরফ পড়বেই। কিন্তু গ্যাংটক, দার্জিলিংয়ে তুষারপাতের জন্য এখন অপেক্ষা করতে হয়। কোনও বছর হয় না। কারণ, যে পশ্চিমী ঝঞ্ঝার প্রভাবে তুষারপাত হয়ে থাকে, তা দার্জিলিং শহর, গ্যাংটকের আকাশে পৌঁছনোর আগেই দুর্বল হয়ে যায়।’’

গোপীনাথ রাহা জানান, পশ্চিমী ঝঞ্ঝা হল সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো। সারা বছরই পর্যায়ক্রমে সৃষ্টি হয়। কেন্দ্রীয় আবহাওয়া মন্ত্রের সিকিমের অধিকর্তার কথায়, ‘‘পশ্চিমী ঝঞ্ঝা বেশি শক্তিশালী থাকে বলে মানালিতে প্রবল তুষারপাত হয়ে থাকে। কিন্তু তা দার্জিলিংয়ে পৌঁছনোর আগে অনেকটাই দুর্বল হয়ে যায় বলে এখানে উঁচু এলাকায় হালকা তুষারপাত হয়। শহরে অনেক বছর হয়ও না।’’

চলতি বছরে অবশ্য দার্জিলিং শহর তুষারপাত দেখেছে। তবে, আগের মতো রাস্তায় বরফের চাদর শহর লাগোয়া এলাকায় দেখা যায়নি। শুধু টাইগার হিলের রাস্তায় দেখা গিয়েছে। এবার পর পর আরও কয়েকটি পশ্চিমী ঝঞ্ঝার সম্ভাবনা রয়েছে বলে আবহাওয়াবিদেরা জানাচ্ছেন। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের শিক্ষক রঞ্জন রায় জানান, আগামী দু’তিনদিনের মধ্যে পশ্চিমী ঝঞ্ঝা ঢুকে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তা শক্তিশালী হলে চলতি বছরেই আরও একবার দার্জিলিং শহর তুষারপাত দেখতে পারে বলে তিনি মনে করছেন তিনি। এই ঝঞ্ঝা শক্তিশালী হলে কনকনে ঠান্ডা উপভোগ করতে পারবেন উত্তরবঙ্গের প্রায় সব এলাকার বাসিন্দারা।

দার্জিলিংবাসীরা আবারও বরফের আশায় প্রহর গুনতে শুরু করেছেন। দার্জিলিয়ের হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইন্সটিটিউটের কিউরেটর চন্দ্রনাথ দাস বলেন, ‘‘পরিবেশ ঠিক রাখতে সরকারি তরফেও নানা পদক্ষেপ করা হচ্ছে। স্বেচ্ছাসেবীদেরও ভূমিকা রয়েছে। পড়ুয়াদের মধ্যে পরিবেশ সচেতনতা বাড়াতে হবে। দার্জিলিং পাহাড়-সহ উত্তরবঙ্গ যাতে ঊষ্ণতর না হয়ে ওঠে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement