বিতর্কসভায় কৌশিক সেন, বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুকান্ত মজুমদার, কুণাল সরকার, ব্রাত্য বসু, সুগত মারজিত, যশোধরা রায়চৌধুরী, আবুল বাশার (বাঁ দিক থেকে)। ছবি: রণজিৎ নন্দী
দু’টি দলে ভাগ হয়ে কোমর কষে বিতর্কে নেমেছিল বাঙালি। এক দিকে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু, অন্য দিকে বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। সেঞ্চুরি প্লাইয়ের পৃষ্ঠপোষকতায়, আইএলএস-এর সহযোগিতায় দেশ পত্রিকা-র বিতর্কসভা কিন্তু বাঙালির রাজনৈতিক রেষারেষিই শেষ কথা বলে মানল না।
শনিবার সন্ধ্যার বিতর্ক সভায় ‘বাংলা এখন নিঃস্ব’-মতটুকুর হয়ে বলতে উঠে সুকান্তের সঙ্গী কৌশিক সেন একটি স্বতন্ত্র স্বর হিসেবেই নিজের কথা বলতে চাইলেন। বললেন, আসলে আমরা বার বার কোনও একটি দলের বাইরে কণ্ঠস্বর খুঁজে পাচ্ছি না বলেই নিঃস্ব। তাঁর প্রতিপক্ষ শিবিরে যশোধরা রায়চৌধুরী আবার বলছিলেন, বাঙালি নিঃস্ব হয়নি ধুতিপাঞ্জাবিধারী তথাকথিত অভিজাত বাঙালির চিরকেলে একটা ধাঁচ (স্টিরিয়োটাইপ) আসলে ধ্বস্ত হচ্ছে। সাহিত্যিক তথা সরকারি আধিকারিক যশোধরার কথায়, ‘‘বাঙালি বনামপন্থী হলেও একটা তৃতীয় পরিসর রয়েছে। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামের সময়ে নাগরিক সমাজের উত্থান তা দেখিয়েছিল। এখনও লিটল ম্যাগাজ়িন, স্বাধীন সিনেমার প্রবক্তারা তা করে দেখাচ্ছেন।’’ গ্রামে স্কুটি চালানো মেয়েদের দস্যিপনার কথাও বললেন যশোধরা।
নরেন্দ্র মোদী বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়— দেশের রাজনীতির আবর্তে ক্ষমতার আলাদা মেরুগুলির কোনওটিকেই কিন্তু রেয়াত করেননি কৌশিক। জয় গোস্বামীর কবিতায় বিঁধেছেন দু’পক্ষকে। এই বিতর্ক সভায় তাঁর পক্ষের লোক সুকান্ত মজুমদারও বাধ্য হয়েছেন কৌশিকের সমালোচনার জবাব দিতে।
কৌশিকদের শিবিরে সাহিত্যিক সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায় দেখেছেন কী ভাবে বাংলা ভাষা তার পাঠক হারাচ্ছে, ক্রমশ পিছিয়ে পড়াদের অবলম্বন হয়ে উঠছে বাংলা। সেই সঙ্গে স্কুল শিক্ষা ব্যবস্থাও চরম সঙ্কটের মুখোমুখি। সাহিত্যিক বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের চোখে আবার বাঙালির নিঃস্বতা তার স্বধর্ম চ্যুতি বা সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞানের মৃত্যুতে। তাঁর আক্ষেপ, ‘‘সারদা শব্দটি পর্যন্ত এখন কলুষ স্মৃতি জাগিয়ে তোলে। ভিন্ন মতও বাঙালি মানতে পারে না। তাই উত্তরপ্রদেশের সিদ্দিক কাপ্পানের মতো দুই বাংলায় সফিকুল ইসলাম বা অম্বিকেশ মহাপাত্রকে ক্ষমতার রোষানলে জ্বলতে হয়।’’ কৌশিক সটান ব্রাত্যকে প্রশ্ন করেছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো দক্ষ রাজনৈতিক নেত্রীকে সাহিত্যিক প্রমাণ করার জন্য বাংলা অ্যাকাডেমির কর্তা ব্রাত্যকেও কেন ‘ব্যবহৃত’ হতে হয়।
প্রতিপক্ষের সব তির তাঁকে বিঁধলেও ব্রাত্য প্রাণপণে লড়াই চালিয়েছেন। বাঙালির উৎকর্ষের প্রমাণ হিসেবে দুই বাংলার সাংস্কৃতিক অখণ্ডতার কথা বলেন তিনি। সে-বাংলার চেতনায় শীর্ষেন্দু, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বা জয় গোস্বামী-আল মাহমুদেরা একাকার। সুকান্ত মজুমদার বলছিলেন, বাংলার শিল্পপতি থেকে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচের গোলদাতারা কেউই আজকাল বাঙালি নন। ব্রাত্যর সপাটে জবাব, ‘‘এই বড় ম্যাচের ইতিহাসে সর্বোচ্চ গোলদাতাদের তালিকায় রয়েছেন ভাইচুং ভুটিয়া, চিমা বা হাবিবরা। হাবিব-আকবরেরা হায়দরাবাদ থেকে এলেও বাঙালি তাঁদের অবাঙালি ভাবেনি। এটাই বাংলার সংস্কৃতি।’’ প্রেসিডেন্সির প্রাক্তনী ব্রাত্যকে সুকান্ত অবশ্য রাজ্যে প্রেসিডেন্সি জেলের গুরুত্বই বেশি বলে খোঁচা দিয়েছেন। ব্রাত্যর শিবিরে আবুল বাশার বাঙালির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নতুন নয় বোঝাতে মঙ্গলকাব্যের ভাঁড়ু দত্তের কথা পেড়েছেন। অর্থনীতিবিদ সুগত মার্জিত রাজ্যের উন্নয়ন প্রকল্প, মসৃণ সড়কের কথা তুলে ধরেন। তাঁর দাবি, ঋণ ও রোজগারের অনুপাতে বাংলার অবস্থা এখনও দেশের সার্বিক অবস্থার থেকে ভাল। তবে এ যাত্রা, দর্শকদের ভোটে ব্রাত্য, সুগতদের যুক্তিরই হার হয়েছে।
রাজ্য সরকারি কর্তারা কেন্দ্রের কাছে বিভিন্ন পরিসংখ্যান কেন পেশ করছেন না, সুগতকে তার খোঁজ নিতে অনুরোধ করেন সঞ্চালক চিকিৎসক কুণাল সরকার। তবে এ বিতর্কে তাঁকে কোনও পক্ষ নিতে হচ্ছে না বলে শুরুতেই সরস ভঙ্গিতে উদ্যোক্তাদের ধন্যবাদ জানান তিনি।