শুভেন্দু অধিকারী (বাঁ দিকে)। (ডান দিকে) মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।
বিজেপির বিরুদ্ধে বিভেদ তৈরির অভিযোগ তুললেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘‘ধর্মের ভিত্তিতে বিবাদ লাগাতে হবে! দলিতদের মুখে প্রস্রাব করে দেওয়া হয়েছে। রাজবংশী ও মতুয়াদের মধ্যে বিভেদ তৈরি করতে হবে! মণিপুরে এমন জাতি দাঙ্গা লাগাল যে, থামছে না।’’ এর পরেই মমতা আগামী ১৬ অগস্টের মধ্যে রাজ্যের পঞ্চায়েতগুলিতে বোর্ড গঠন করতে হবে বলে বিধায়কদের নির্দেশ দেন। না হলে বিডিও, জেলাশাসকদের হাতে চলে যাবে। এর পরেই ‘জয় ইন্ডিয়া, জয় বাংলা’ বলে বক্তৃতা শেষ করলেন মুখ্যমন্ত্রী।
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘সব কিছুতে পিএম (প্রধানমন্ত্রী)-এর নাম। ওয়াশরুম থেকে শ্মশান— সব জায়গাতেই পিএমের নাম দিচ্ছে। যে দিন তুমি থাকবে না, সব সরে যাবে।’’ ১০০ দিনের কাজের প্রসঙ্গও তুলেছেন মমতা। তাঁর কথায়, ‘‘১০০ দিনের কাজের ৭,০০০ কোটি টাকা আটকে রাখা হয়েছে। বিজেপি নেতারা বলেন, তাঁরা বলেছেন, তাই টাকা আটকে রেখেছে। আবাস যোজনা বন্ধ করে দিয়েছে। মিড ডে মিল, সড়ক নির্মাণ বন্ধ করে দিয়েছে। এটা তোমার একার অধিকারে নেই! পিএম কেয়ারে কত টাকা জমা পড়ল, তার কী হল? ২০০০ টাকার নোট বাতিল করা হল! সে সব কোথায় গেল?’’
মমতা বলেন, ‘‘যে দিন থেকে এসেছে, বাংলাকে খারাপ বলে। বাংলাকে নষ্ট করার চেষ্টা। বিশ্বভারতীর উপাচার্য নাকি অমর্ত্য সেনের বাড়ি দখল করবেন! আমরা রয়েছি এখনও। কী ভাবে মানুষকে সম্মান দিতে হবে, জানি।’’
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘এখানে নাকি রোজ সন্ত্রাস চলছে! হয় মাথায় কিছু হয়েছে, নয় কেন্দ্রকে খুশি করতে হবে! বিজেপি ফেক ভিডিয়ো, ফেক নিউজে বিশ্বাস করে। আমাদের পুলিশকে গুলি করল কে? এত বোমা কোথা থেকে এল? বিডিয়োকে কে মারতে গিয়েছিল?’’ নাম না করে শুভেন্দুকে কটাক্ষ করেন মমতা। তিনি বলেন, ‘‘নিজের জেলায় হারল কী ভাবে? নন্দীগ্রামে ১০,০০০ ভোটে হার! নাম নিচ্ছি না। নাম নিতে লজ্জা হয়! তমলুক, খেজুরিতে আজ লোক ঢুকতে পারছে না।’’
মুখ্যমন্ত্রী পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলেন, ‘‘পঞ্চায়েত সমিতিতে ৭,৮৫৫টি পেয়েছে তৃণমূল। বিজেপি পেয়েছে ১,০৭৪টি। জেলা পরিষদে তৃণমূল ৮৭৯টি ভোট পেয়েছে। বিজেপি পেয়েছে ৩১টি। কংগ্রেস ১৪টি পেয়েছে। ভোট লুট হলে পেল কোথা থেকে? মানুষের মঙ্গলময় কাজের পুরস্কার দেওয়া হয়েছে।’’
পঞ্চায়েত ভোটে মৃত্যুর পরিসংখ্যান তুলে ধরে মমতা বললেন, ‘‘৮০ হাজার কেন্দ্রীয় বাহিনী ছিল। তাদের নাকের ডগায় এমন ঘটনা ঘটল!’’
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘আমরা এতটা মানবিক, যাঁরা মারা গিয়েছেন, তাঁদের টাকা ও হোমগার্ডের চাকরি দিয়েছি। রেল দুর্ঘটনায় যাঁরা মারা গিয়েছেন, তাঁদের ৫ লাখ টাকা দিয়েছি। আমি ইচ্ছে হলেই কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারি না।’’ কোন বছর ভোটে কত জন মারা গিয়েছেন, সেই পরিসংখ্যানও তুলে ধরেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘১৯৯২ সালে পঞ্চায়েত ভোটে ৫৯ জন মারা যান। ২০০৩ সালে ৭৯ জন মারা যান। ২০০৮ সালে ভোটের দিন ১৯ জন মারা যান। ২০১৩ সালে ১৪ জন মারা যান। ২০১৮ সালে ২২ জন মারা গিয়েছেন। ২০২৩ সালে ভোটের আগে ২৯ জন মারা গিয়েছেন।’’
পঞ্চায়েত ভোটে হিংসার অভিযোগ তুলছে বিরোধীরা। আঙুল তুলেছে শাসক দল ও রাজ্য সরকারের দিকেও। বিধানসভায় এ নিয়ে বৃহস্পতিবার পাল্টা বিজেপির দিকে আঙুল তুললেন মমতা। তিনি বলেন, ‘‘পাহাড় থেকে জঙ্গল— শান্তিতে ছিল। পুরুলিয়া, বাঁকুড়ায় গোলমাল হয়নি। পূর্ব মেদিনীপুরে ঘর পুড়িয়েছে কারা? নন্দীগ্রামে এক জন মহিলাকে বিজেপি ধর্ষণের হুমকি দিয়েছিল।’’ এর পর মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘সাতটি ঘটনা ঘটেছে। আর তুমি ২২-২৩টি জেলার বদনাম করছ? পান্নালালের ছেলে নন্দলাল।’’
মমতা বলেন, ‘‘এঁরা বাংলাকে বদনাম করে বেড়ান। বিজেপিতে গিয়ে সকলের নবজন্ম হয়। আমি তো বলিনি কিছু ঘটেনি। বামফ্রন্ট সিস্টেম করে দিয়ে গিয়েছে, পরিবারে পরিবারে লড়াই হয়। এর জন্য নবজোয়ার হয়েছিল। মানুষকে বোঝানো হয়েছে।’’
মণিপুর নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে আগেও কটাক্ষ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। সেখানে রাজ্যের প্রতিনিধি দলও পাঠিয়েছিলেন তিনি। এ বার বিধানসভায় বললেন, ‘‘মণিপুর নিয়ে অত ভয় কিসের? আপনি এ দিকে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, টাকা দিয়ে উপহার দিচ্ছেন। আর মণিপুর জ্বলছে। মিজোরাম জ্বলছে।’’
মমতা বলেন, ‘‘৩৫৫ ৩৫৬ করব, কে বলেছিল? কার্পেট বম্বিং করবে কে বলেছিল? আপনারা তো আর ৬ মাস রয়েছেন। আর কাকে কার্পেট বম্বিং করবেন? মানুষকে?’’
মুখ্যমন্ত্রী জানান, পঞ্চায়েত ভোটে ২ লক্ষ ৩১ হাজার ৮০০ মনোনয়ন জমা পড়েছে। তবে তৃণমূল একা লড়াই করেছে। তাঁর কথায়, ‘‘৫৪,৬২০টি মনোনয়ন জমা পড়েছে বিজেপির। কংগ্রেস ১৭ হাজার, বামফ্রন্ট ২৭ হাজার ৭৮৭ মনোনয়ন জমা করেছে। ২০১৮ সালে ৬৫ শতাংশ মনোনয়ন হয়েছিল। এ বার ৮৭ শতাংশ হয়েছে। ৩৯৮ জন পর্যবেক্ষক ছিল। ৬৯৬টি বুথে পুননির্বাচন হয়েছে। আপনারা বলছেন গন্ডগোল হয়েছে? ভোটের বাক্স জলে ফেলে দিন, কে বলেছিল?’’
বিজেপিকে বিধানসভায় একহাত নিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। তিনি বলেন, ‘‘উত্তরপ্রদেশ দেখাচ্ছ? ১,১০০ মানুষকে এনকাউন্টার করা হয়েছে। ত্রিপুরায় ৯৭ শতাংশ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। গুজরাতে ইউএপিএ কী হয়েছে? মিডিয়া বাংলায় এক তরফা। ২ লাখ মনোনয়ন হয়েছে যা রেকর্ড।’’
বিজেপি বিধায়কেরা কালো কাপড় দেখিয়ে ওয়াক আউট করলেন বিধানসভা থেকে। মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে ‘শেম শেম’ ধ্বনি দিলেন তাঁরা।
মমতা বলেন, ‘‘আমারও কথা বলার অধিকার রয়েছে। মামলা হয়েছিল। সেটা পেন্ডিং রয়েছে। আপনারা বলেছেন, সারা ভারতে কোথাও সন্ত্রাস হয়নি। ত্রিপুরায় কী হয়েছে?’’
মুখ্যমন্ত্রী নন্দীগ্রাম প্রসঙ্গ তুলতেই বিজেপি বিধায়কদের বিক্ষোভ শুরু হয় বিধানসভায়। শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে স্পিকারের বাক্য বিনিময় শুরু হয়। বিজেপি বিধায়কদের বসতে অনুরোধ করলেন স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়।
মমতা বিধানসভায় বলেন, ‘‘যিনি এর আগে বললেন, তিনি তৃণমূলে ছিলেন, তিনি আগের কথা বললেন না। সিপিএম জমানার কথা বলা হয় না। কেন্দ্র যেমন ভোট করায় না, তেমনই রাজ্য সরকার ভোট করায় না। লোকসভা ও বিধানসভা ভোটে চিরকুটে পুলিশ বদল। নন্দীগ্রামে দু’ঘণ্টা লাইট বন্ধ করে দিয়ে কী হয়েছিল ভুলে গেলেন।’’
মমতা বলেন, ‘‘এখানে কেউ বলতে পারবেন না, সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করা হয়। সকালে বলে দেওয়া হয়, বিজেপির পক্ষে খবর করতে হয়। বিজেপির বিরুদ্ধে বলা যাবে না।’’
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঢুকলেন বিধানসভায়। তিনি বলেন, ‘‘সরকার ও বিরোধীদের ধন্যবাদ জানাই। প্রয়াত বিধায়কের পরিবারকে সমবেদনা জানাই। আলোচনা হতেই পারে। আমি সব শুনেছি।’’