প্রয়াত মনমোহন সিংহ। —ফাইল চিত্র।
বাজপেয়ী সরকারের স্লোগান ‘শাইনিং ইন্ডিয়া’র প্রচারে তখন তুলকালাম চলছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। উল্টো দিকে বিজেপির রথ প্রতিহত করতে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা ছুটে বেড়াচ্ছেন সনিয়া গান্ধী। রাজনীতিতে সবে মুখ দেখিয়েছেন তখনও যথেষ্ট অপ্রতিভ রাহুল গান্ধী। ২০০৪-এর লোকসভা ভোট কড়া নাড়ছে দ্বারে।
এই সময়ে কংগ্রেসের মুখপাত্র আনন্দ শর্মা নয়াদিল্লিতে তাঁর বাংলোয় একটি নৈশভোজের আয়োজন করেন। আদতে সাংবাদিকদের ডেকে শেষ মুহূর্তের খবরের আদানপ্রদানই মুখ্য উদ্দেশ্য। রয়েছেন কংগ্রেসের কিছু ছোট-বড় নেতাও। তবে সমস্ত ভিড় সে দিন গৃহস্বামী আনন্দ শর্মাকে ঘিরে।
সেই প্রশস্ত লনের এক কোণে, কিছুটা একলা হয়েই দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। তখন তিনি রাজ্যসভার প্রধান বিরোধী দলনেতা, কিন্তু অনাড়ম্বর মৃদুভাষে রাজনীতির উচ্চকিত ঢক্কানিনাদে বেমানান। হাল্কা নীল পাগড়ি, তখনও দাড়িতে সাদার ছোপ কম। দেড় বছর হয়েছে দিল্লিতে আমার পা রাখার তখন। সামনেই মনমোহন সিংহ এ ভাবে একলা দাঁড়িয়ে, হাতে ফলের রসের গ্লাস সম্ভবত। পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে, সামান্য নার্ভাস হয়ে কথা শুরু। তখনও আমরা কেউই জানি না, আর কয়েক সপ্তাহ পর এঁর সঙ্গে দেখা করতে চারটি নিরাপত্তার বলয় পার হতে হবে এবং তা-ও দেখা পাওয়া যাবে না। সে দিন সহজ করে বুঝিয়েছিলেন রাজনীতির কথাই। ২০০৪-এর ভোট কেন আলাদা, তার কয়েকটি কারণ বলেছিলেন। মনে আছে মনমোহন বলেছিলেন, সে বারের ভোটের প্রচার যে ভাবে বৈদ্যুতিন চ্যানেল নিয়ন্ত্রণ করেছে, আগে এমনটা কখনও ঘটেনি। বোঝাই যাচ্ছে, ওই সময়ে নেটপ্রযুক্তির নামও ভারতীয় রাজনীতি শোনেনি।
সংসদের বর্ষাকালীন অধিবেশন চলছে। সংসদের সেন্ট্রাল হল থেকে বেরিয়েই ছিল একটি লস্যির কাউন্টার। সাধারণত সাংসদ-মন্ত্রীদের জন্য লস্যি পাঠানো হত ভিতরে। সাংবাদিকরাও ওই কাউন্টার থেকে কিনতে পারতেন লস্যি এবং চা-কফি। এই রকমই কোনও উদ্দেশ্যে সেখানে গিয়ে একটি দৃশ্য দেখি, যা চিরকালীন ফ্রেম হয়ে থেকে গিয়েছে সঙ্গে। মনমোহন সিংহ লস্যি নিয়েছেন। তখনও তিনি প্রধানমন্ত্রী নন। সাদা পাঞ্জাবির দু’পকেট হাতড়ে খুচরো বার করছেন। দু’তিন টাকার কয়েন কম পড়ছে! লস্যি বিক্রেতা লজ্জায় মাটিতে মিশে যান আর কি! অনুরোধ করছেন, “স্যর আপনি এটা নিন, এ সব ভাববেন না।” কিন্তু তিনি মনমোহন, ভারতীয় অর্থনীতিকে বদলে দেওয়া নব্বইয়ের নায়ক, তিন টাকা কম দিয়ে লস্যিটি কিনবেন না! এই দৃশ্য সত্যিই যে কখনও দেখেছিলাম, সেটা আজ সংসদে দাঁড়িয়ে যেন বিশ্বাসই হয় না।
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে ওঁর সফরসঙ্গী হয়ে দেশের ভিতরে ও বাইরে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। তাঁর অনাড়ম্বর যাপন ও জীবনের ঝলক দেখেছি। বিমানে তাঁর জন্মদিনের কেক কাটা হয়েছে। সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন, সেখানেও সেই মেধার ঝলক। তাঁর অফিসের প্রবীণ আমলারা বলতেন, মনমোহন ও মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়া যখন বাজেটের চূড়ান্ত খসড়াটি নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেন, তাতে নাকি তাঁদের দশ-পনেরো মিনিটের বেশি সময় লাগে না। এবং তাঁরা এতটাই সংক্ষিপ্তসারে ওই বিরাট বাজেটের মর্মকথা বিনিময় করে নেন, তা বাকিদের ধরতে অসুবিধাই হয়।
প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গেও তাঁর কতই না গল্প। প্রণব অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর হয়ে তাঁর অধীনে দীর্ঘদিন কাজ করেন মনমোহন। প্রণবকে ডাকতেন ‘স্যর’। পরে ২০০৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরেও প্রথম মন্ত্রিসভাতেও প্রণবকে সেই ‘স্যর’ সম্বোধন মনমোহনের! প্রণববাবু হাত জোড় করে বলেছিলেন, ‘আপনি দেশের প্রধানমন্ত্রী। আমায় আপনি স্যর বলে ডাকলে আমার পক্ষে মন্ত্রিসভার বৈঠকে আসাই কঠিন হবে।’
দেশের অর্থনীতিতে তাঁর অবদান নিয়ে বহু আলোচনা। তবে শুধু অর্থনীতিই নয়, রাজনীতিতেও এক বিরল ঐতিহ্যকে সঙ্গে নিয়ে আজ চলে গেলেন মনমোহন সিংহ।