কেন্দ্রীয় বাহিনীকে ময়দানে দেখতে না পাওয়ার জন্য রাজ্য প্রশাসনের দিকেই আঙুল তুলেছে বিজেপি। —ফাইল চিত্র।
পঞ্চায়েত ভোটের দিন অশান্তি, সংঘর্ষের সময়ে প্রায় কোথাও দেখা মেলেনি কেন্দ্রীয় বাহিনীর। ভোট মিটে গেলেও বিভিন্ন জেলা থেকে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন সংক্রান্ত বিভ্রান্তির অভিযোগ আসা অব্যাহত। কোথাও স্পর্শকাতর এলাকার নাম নেই, কোথাও আবার সেই এলাকা ধরে বাহিনী মোতায়েনের খবর নেই। কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে ভোট করানোর জন্য আদালতের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও কেন এমন অবস্থা হল, তা নিয়ে তুঙ্গে উঠেছে রাজনৈতিক চাপান-উতোর।
পুলিশ-প্রশাসনের সক্রিয় মদতে ভোট লুট হয়েছে বলে অভিযোগ করতে গিয়েই প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী রবিবার ফের বলেছেন, ‘‘কেন্দ্রীয় বাহিনী থাকলে সাগরদিঘি মডেলে ভোট হত পঞ্চায়েতেও। দিদি-মোদী সমঝোতার জন্য ভোটের দিন কেন্দ্রীয় বাহিনী এসেছে। কিন্তু বুথে যায়নি। এতে সাপও মরল, লাঠিও ভাঙল না! আর তাই এত ছাপ্পা, এত লুট। তৃণমূলের নির্দেশে শনিবার সারা দিন বসিয়ে রাখা হয়েছে কেন্দ্রীয় বাহিনীকে। এই রাজ্য নির্বাচন কমিশনারকে কোমরে দড়ি বেঁধে গ্রেফতার করা উচিত!’’ ভোটের দিন আইনশৃঙ্খলা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিল বলে অভিযোগ করে এ দিনই রাজ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব সিন্হাকে চিঠি দিয়ে অধীর দাবি জানিয়েছেন, অন্তত পুনর্নির্বাচনের সময়ে প্রতিটি ভোটারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা হোক।
কেন্দ্রীয় বাহিনীকে ময়দানে দেখতে না পাওয়ার জন্য রাজ্য প্রশাসনের দিকেই আঙুল তুলেছে বিজেপি। দলের সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি দিলীপ ঘোষের বক্তব্য, ‘‘কোথায় ছিল কেন্দ্রীয় বাহিনী? জাতীয় সড়কে গাড়ি করে ঘুরছিল! থানায় বসিয়ে রাখা হয়েছিল। আদালত জোর করে পাঠিয়েছে কিন্তু প্রশাসন ব্যবহার করেনি। প্রশাসন কেন্দ্রীয় বাহিনীকে ব্যবহার করলে এত মানুষ খুন হত না।’’ বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারেরও অভিযোগ, সংবদেনশীল বা স্পর্শকাতর এলাকার তালিকা কেন্দ্রীয় বাহিনীর কাছে পৌঁছেই দেওয়া হয়নি। এই প্রসঙ্গে বিএসএফের অভিযোগের উল্লেখ করেছেন তিনি।
রাজ্য তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ অবশ্য পাল্টা বলেছেন, ‘‘ওরাই (কেন্দ্র) তো কেন্দ্রীয় বাহিনী পুরোটা পাঠায়নি! চেয়েও সময় মতো পাওয়া যায়নি বাহিনীকে। আর কেন্দ্রীয় বাহিনী এলেই যে শান্তিপূর্ণ ভোট হবে, কে বলেছে? গত বার তো কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলিতেই মারা গিয়েছিল? মণিপুরে কী হচ্ছে?’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘যে কোনও প্রাণ যাওয়াই দুর্ভাগ্যজনক। কিন্তু ৬১ হাজারের বেশি বুথ, তার মধ্যে কিছু বুথে হিংসা হয়েছে। অবশ্যই অবাঞ্ছিত। বেশির ভাগই তৃণমূলের লোক মারা গিয়েছেন।’’ আর সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীর দবি, ‘‘সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিয়ে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার এবং রাজ্য নির্বাচন কমিশন মিলে ছেলেখেলা করেছে! এ বার ভোট-গণনায় অন্তত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হোক।’’
বিভিন্ন জেলা থেকেই কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন নিয়ে নানা বিভ্রান্তি ও অসঙ্গতির অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। বীরভূমের পুলিশ সুপার শুক্রবার জানিয়েছিলেন, জেলায় কোনও স্পর্শকাতর বুথ নেই। তবে প্রতি বুথে অন্তত দু’জন করে কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ান রাখা হবে। কিন্তু শনিবার জেলার অন্তত ৫০% বুথেই কেন্দ্রীয় বাহিনীর দেখা মেলেনি বলে অভিযোগ। পাশাপাশি যে বাহিনী এসেছিল, তার বড় অংশকে বসিয়ে রাখা হয়েছিল, কাজেই লাগানো হয়নি বলেও অভিযোগ।
ভোটের আগে স্পর্শকাতর থানা এলাকার নাম জানানো হলেও দুই ২৪ পরগনায় বুথের নাম জানাতে পারেনি রাজ্য প্রশাসন। উত্তর ২৪ পরগনার আমডাঙা, দেগঙ্গা ও বারাসত-১ ব্লকে স্পর্শকাতর ও অতি স্পর্শকাতর বুথ ছিল। তিন ব্লকে ভোটের আগে শুক্রবার গভীর রাতে, কোথাও শনিবার সকালে কেন্দ্রীয় বাহিনী ও ভিন্ রাজ্যের পুলিশ পৌঁছয়। ভোটের আগে থেকেই দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙড় থানায় এক কোম্পানি বিএসএফ ও কাশীপুর থানায় এক কোম্পানি সিআরপিএফ ছিল। ভোট চলাকালীন বিকেল চারটে নাগাদ কাশীপুর থানায় এসে পৌঁছয় তিন কোম্পানি পঞ্জাব পুলিশ।
দুই বর্ধমানে স্পর্শকাতর এলাকার তালিকা কমিশনের তরফে দেওয়া হয়নি। ফলে, সেখানে বাহিনী ছিল কি না, বোঝাই যাচ্ছে না! দুই বর্ধমানে ভোটের পরে বাহিনী পৌঁছনোর ঘটনাও নেই। আরামবাগ মহকুমার অধিকাংশ এলাকাতেই শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত কেন্দ্রীয় বাহিনী দেখা যায়নি। তবে গভীর রাতে আরামবাগে এসে পৌঁছয় বাহিনী। থেকে ধামসা, হিয়াতপুর, খানাকুল-২ ব্লকের পলাশপাই, চিংড়া, পুরশুড়ার ভাঙামোড়া, শ্যামপুর এবং গোঘাটের কুমারগঞ্জে এ দিন সকাল থেকে টহলদারি চলে।
প্রশাসনের দাবি, হাওড়ার ২৩৩টি স্পর্শকাতর বুথে ভোটের দিন সকাল থেকেই কেন্দ্রীয় বাহিনী ছিল। এর মধ্যে গ্রামীণ এলাকায় ১৫ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী এসেছে। কিন্তু ভেোটের সময় বহু বুথেই বাহিনীর দেখা মেলেনি।পশ্চিম মেদিনীপুরে শনিবারের পরে এ দিনও কেন্দ্রীয় বাহিনী সে ভাবে দেখা যায়নি। পূর্ব মেদিনীপুরের খেজুরির রামচকে এ দিন দুপুরে বহিরাগতদের বিরুদ্ধে হুমকি দেওয়ার অভিযোগ তুলে পথ অবরোধ করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। সেখানে অবশ্য ভিন্ রাজ্যের পুলিশ-কর্মীরা যান। শনিবার ঝাড়গ্রাম জেলার এক সময়ের মাওবাদী প্রভাবিত বেলপাহাড়ির বুথগুলিতে কেন্দ্রীয় বাহিনী দেখা যায়নি। তবে লালগড়ের অতিস্পর্শকাতর একটি-দু’টি বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী ছিল। জঙ্গলমহলের এই জেলায় এ দিনও কেন্দ্রীয় বাহিনীকে টহল দিতে দেখা যায়নি। স্ট্রংরুমগুলিতে অবশ্য ভিন্ রাজ্যের পুলিশ ও কেন্দ্রীয় বাহিনীকে দেখা গিয়েছে।