Cyclone Amphan

কালভৈরব! সুন্দরবন-সহ দুই ২৪ পরগনা তছনছ-লন্ডভন্ড

অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় আমপানের প্রভাবে রাজ্যে রাত পর্যন্ত ১০-১২ জনের মৃত্যুসংবাদ মিলেছে বলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ মে ২০২০ ০৪:০১
Share:

ঘূর্ণিঝড়ের কাছে অসহায় মানুষ। ছবি: পিটিআই।

একে বিধ্বংসী ঝড়, তার উপরে নদীতে ভরা জোয়ার। প্রবল হাওয়া, অতিবৃষ্টির সঙ্গে জলোচ্ছ্বাসের ত্র্যহস্পর্শে বুধবার লন্ডভন্ড হয়ে গেল সুন্দরবন-সহ দক্ষিণ ও উত্তর ২৪ পরগনার বিস্তীর্ণ এলাকা। প্রবল দুর্যোগের কবলে কলকাতাও। অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় আমপানের প্রভাবে রাজ্যে রাত পর্যন্ত ১০-১২ জনের মৃত্যুসংবাদ মিলেছে বলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন। তবে ক্ষয়ক্ষতির পুরো হিসেব জানা যায়নি।

Advertisement

প্রশাসন সূত্রের খবর, কলকাতার রিজেন্ট পার্কে দেওয়াল চাপা পড়ে এক মহিলা ও তাঁর ছেলের মৃত্যু হয়েছে। রাত পর্যন্ত তাঁদের পরিচয় জানা যায়নি। কলকাতায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে আরও দু’জনের মৃত্যুসংবাদ মিলেছে। উত্তর ২৪ পরগনার মিনাখাঁয় নুরজাহান বেওয়া নামে এক মহিলা (৫৬) গাছ ভেঙে পড়ে এবং গোপাল ভুঁইয়া (৩২) নামে এক যুবক ঝড়ে উড়ে আসা অ্যাসবেস্টসের আঘাতে মারা গিয়েছেন। বসিরহাট-২ ব্লকের মোহান্ত দাস (২০) নামে এক যুবক গাছ পড়ে এবং হাওড়ার বটানিক্যাল গার্ডেন এলাকায় লক্ষ্মীকুমার সাউ নামে বছর তেরোর এক কিশোরী বাড়ির টিনের চাল ভেঙে মারা গিয়েছেন। পূর্ব মেদিনীপুরের ভূপতিনগরে মাটির বাড়ি চাপা পড়ে ছবিরানি শিট (৫৮) এক মহিলার মৃত্যুর খবর মিলেছে। আহত হয়েছেন তাঁর ছেলে।

পূর্ব বর্ধমানের মন্তেশ্বরে তিন জন এবং পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুকে এক মহিলা আহত হয়েছেন। কচুবেড়িয়া জেটি ভেঙে মূল ভূখণ্ড থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে সাগরদ্বীপ। নামখানা, গোসাবা, পাথরপ্রতিমা, ভাঙড়, বসিরহাট-সহ বিস্তীর্ণ এলাকায় প্রচুর ঘরবাড়ি, মাঠের আনাজ নষ্ট হয়েছে। সুন্দরবনে বন দফতরের বিভিন্ন ক্যাম্পে জল ঢুকেছে। তবে প্রচুর মানুষকে আগেভাগে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়ায় মৃত্যু অনেকটাই এড়ানো গিয়েছে। জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী ডিজি এস এন প্রধান জানান, পশ্চিমবঙ্গে ৫ লক্ষ ও ওড়িশায় প্রায় দেড় লক্ষ লোককে নিরাপদ স্থানে সরানো হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশায় বাহিনীর ৪১টি দল কাজ করছে।

Advertisement

ঝড়ের গতিবেগ

• সাগরদ্বীপে ১৮৫
• কলকাতা ১১৪
• দমদম ১৩৩
• হলদিয়া ৯২

গতিবেগ কিমি / ঘণ্টায়।
সূত্র: আবহাওয়া দফতর

আবহাওয়া বিভাগের ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল (পূর্বাঞ্চল) সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, সুন্দরবন-সহ উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার উপকূলে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১৮৫ কিমি বেগে ঝড় বয়ে গিয়েছে। আয়লার সময়ে উপকূলবর্তী এলাকায় ঝড়ের সর্বোচ্চ বেগ ছিল ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার। আর কলকাতায় আয়লার গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১১০ কিলোমিটার। এ দিন আমপানের তাণ্ডবের সময়ে দমদমে ঝড়ের সর্বোচ্চ বেগ ছিল ঘণ্টায় ১৩৩ কিলোমিটার এবং কলকাতার আলিপুরে ১১৪ কিলোমিটার। রাত পর্যন্ত কলকাতায় বৃষ্টি হয়েছে ২৪৪.২ মিলিমিটার। হাওয়া অফিসের খবর, মে মাসে কলকাতায় এক দিনে এত বৃষ্টি আগে দেখা যায়নি। সঞ্জীববাবু জানান, কলকাতায় তাণ্ডব চালিয়ে ঝড়টি নদিয়া ও মুর্শিদাবাদের দিকে বয়ে গিয়েছে। আজ, সকালে সেটি বাংলাদেশে ঢুকতে পারে। তবে তার প্রভাব আজ, বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ লাগোয়া জেলাগুলিতে পাওয়া যাবে।

যে বিপর্যয় দুই ২৪ পরগনায় হয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে ইতিহাস-গবেষকদের অনেকেই বলছেন, ১৮৭৬ সালে বাখরগঞ্জে ঘূর্ণিঝড়ের বিপর্যয়ের পিছনেও এমন ভরা জোয়ারের ভূমিকা ছিল। ইতিহাসবিদ বেঞ্জামিন কিংসবেরির ‘অ্যান ইম্পিরিয়াল ডিজ়াস্টার: দ্য বেঙ্গল সাইক্লোন অব ১৮৭৬’ বইয়েও জোয়ারের সঙ্গে ঘূর্ণিঝড় ও বৃষ্টির ত্র্যহস্পর্শের উল্লেখ রয়েছে।
২০০৯ সালে রাজ্যের উপকূলে ঘূর্ণিঝড় আয়লা আছড়ে পড়েছিল। ২০১৯ সালে নভেম্বরে বুলবুলের দাপটে তছনছ হয়েছিল দুই ২৪ পরগনা। এ দিনও ওই দুই জেলাই সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। মহানগরেও ক্ষয়ক্ষতি কম হয়নি। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের নতুন ছাত্রাবাসের গেট ভেঙে ও জানলা ভেঙে পড়েছে। এসএসকেএম হাসপাতালের বিভিন্ন ভবনের কাচ ভেঙেছে। সেই সব ওয়ার্ডের রোগীদের অন্যত্র সরানো হয়েছে। পরিষেবা স্বাভাবিক রাখতে রাতে হাসপাতালে থেকেছেন সুপার রঘুনাথ মিশ্র-সহ হাসপাতালের কর্তারা।
কলকাতা পুরসভা সূত্রে খবর, শহরে অন্তত ৩০০ গাছ ভেঙেছে। বিদ্যুৎহীন বহু এলাকা।

আমহার্স্ট স্ট্রিটে গাছের তলায় চাপা পড়েছে ট্যাক্সি। বুধবার। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।

লণ্ডভণ্ড অবস্থা বিধাননগর পুর এলাকার। নিউ টাউন, রাজারহাটেও বহু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সল্টলেকের অধিকাংশ ওয়ার্ডে গাছ ভেঙে পড়েছে। দত্তাবাদ-সহ একাধিক জায়গায় কাঁচা ঘর ভেঙে পড়েছে। তবে বিপজ্জনক বাড়ি, নিচু এলাকা থেকে আগেই লোকজনকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিয়েছিল প্রশাসন।
উত্তর ২৪ পরগনায় সব থেকে বেশি ক্ষতি হয়েছে বসিরহাটে। প্রশাসনের দাবি, প্রায় ৮০ হাজার মানুষ ত্রাণশিবিরে রয়েছেন। জেলায় প্রায় ১০ হাজার বাড়ির ক্ষতি হয়েছে। দমদম, বিরাটি, নিউ ব্যারাকপুর, মধ্যমগ্রাম, বারাসতের বহু এলাকায় খুঁটি উপড়ে বা ট্রান্সফর্মার ফেটে বিদ্যুৎ বিপর্যয় হয়েছে। হাওড়ার বহু জায়গায় বাড়ি ভেঙেছে, গাছ ও বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে পড়েছে। ঝড়ের দাপটে ঘটনাস্থলে পৌঁছতে হিমশিম খেয়েছে বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী, পুলিশ। বালি-সহ বহু এলাকায় বিদ্যুৎ বিপর্যয় হয়েছে। জলোচ্ছ্বাস হাওড়া ফেরিঘাটের সবচেয়ে উঁচু জেটিকেও ছাপিয়ে গিয়েছে। হাওড়ার ৫০০ বাসিন্দাকে আশ্রয় শিবিরে রাখা হয়েছে।
প্রশাসন জানায়, কাঁথি মহকুমার কয়েক জায়গায় সমুদ্র বাঁধের ক্ষতি হয়েছে। তাজপুর, জলধা, চাঁদপুর, লছিমপুরের মতো বেশ কয়েকটি গ্রামে জল ঢুকেছে। দিঘায় একাধিক জায়গায় গাছ ভেঙে পড়েছে। ক্ষতি হয়েছে প্রচুর কাঁচাবাড়ির। নদিয়ায় প্রশাসন ৪৯৫টি ত্রাণ শিবির খুলেছে। রয়েছে ফ্লাড শেল্টারও।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement