ভেঙে পড়া বাড়ির সামনে দেবীপুরের মহম্মদ জিয়াউল লস্কর। নিজস্ব চিত্র
যেন দুঃস্বপ্নের প্রহর! অশনি সঙ্কেত আগে থেকেই ছিল। বুধবার বেলা গড়াতেই মাতলার দিক থেকে ধেয়ে এসেছিল ঝোড়ো হাওয়া। বিপদ বুঝে পড়ি কি মরি দৌড় দিয়েছিলেন কুলতলির দেউলবাড়ির দেবীপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের বাসিন্দারা। আশ্রয় নিয়েছিলেন স্থানীয় সাইক্লোন সেন্টারে। সেখান থেকেই রাতভর আমপান (প্রকৃত উচ্চারণ উম পুন)-এর প্রচণ্ড গর্জন শুনেছেন তাঁরা। সকালে পরিস্থিতি বদলাতে অনেকেই ফিরেছিলেন নিজের বাড়িতে। কিন্তু এখন সেখানে বসত ভিটে কোথায়? পড়ে আছে স্রেফ তার কঙ্কাল। জমির ধান গিলে খেয়েছে নোনা জল। অবশিষ্ট ভাঙা দেওয়ালের চৌহদ্দিতে এখন উঠছে সর্বস্ব হারানোর হাহাকার।
দেবীপুরে মাতলার ধারেই বাড়ি মহম্মদ জিয়াউল লস্করের। দুই ছেলে, দুই মেয়ে আর স্বামী-স্ত্রী মিলে জিয়াউলের ছ’জনের সংসার। মাতলায় মীন ধরা পেশা তাঁর। ২০০৯-এর ২৫ মে এসেছিল আয়লা। তার পর ফণী, বুলবুলের ধাক্কা। সে সব স্মৃতি এখনও টাটকা জিয়াউলের মনে। কিন্তু বুধবার যা ঘটল সেই অভিজ্ঞতা শোনাতে গিয়ে তিনি বললেন, ‘‘এমন ঝড় জীবনে দেখিনি।’’ ওই দিন জিয়াউল রাত কাটিয়েছেন সাইক্লোন সেন্টারে। সকালে বাড়ি ফিরতেই দেখতে পান ঝড়ের ধ্বংসলীলা। দূর থেকেই নজরে আসে রাস্তার দু’ধারের ধান খেত জলে ডুবে গিয়েছে। ভাঙা দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়েই জিয়াউল বিষণ্ণ গলায় বললেন, ‘‘নিজের বাড়িটা এখন চেনাই যাচ্ছে না। চাল ঝড়ে উড়ে গিয়েছে। মাটির দেওয়াল ধসে পড়েছে। সকালে বাড়ি ঢুকতেই দেখতে পেলাম মাছ ধরার হাঁড়ি ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে।’’ সরকারি সাহায্যের কথা তুলতেই ফের আয়লার কথা টেনে আনলেন জিয়াউল। বললেন, ‘‘সে সময় সরকারি সাহায্যের আশ্বাস দেওয়া হলেও কেউ কথা রাখেনি। মীন ধরে দিনে শ’দেড়েক টাকা আয় ছিল। লকডাউনের সময় থেকে সেই কাজ বন্ধ। পেটে ভাত এমনিতেই জুটছিল না। এ বার মরার উপর খাঁড়ার ঘা দিল আমপান। আর কত ঝড়ঝাপটা সইব?’’
জিয়াউলের কথাটা কেড়ে নিলেন তাঁর প্রতিবেশী মইনুদ্দিন শেখ। বললেন, ‘‘আয়লা, বুলবুলের পর এ বার আমপান। আর ক’টা ঘূর্ণিঝড় সামলালে সরকারি সাহায্য মিলবে?’’ সমস্বরেই তাঁরা অভিযোগ করলেন, ঝড়ের সময় বাড়ি তৈরির টাকা দেওয়া হবে এমন আশ্বাস দেন নেতারা। কিন্তু দুর্যোগ কাটলে তাঁদের দিকে আর মুখ ফিরিয়েও চান না কেউ।
আমপানের তাণ্ডবে বিধ্বস্ত কুলতলির দেবীপুর। (ছবি:অর্চিষ্মান সাহা)
আরও পড়ুন: আমপানে তছনছ বাংলা, মৃত অন্তত ৭২, ‘এসে দেখে যান’, মোদীকে বললেন মমতা
কোলে বছর দেড়েকের সন্তানকে নিয়ে মাতলার পাড় ধরেই হেঁটে যাচ্ছিলেন ছায়রা খাঁ। দূরে জমির দিকে আঙুল তুলে বললেন, ‘‘ওই ওখানে আমার ঘর ছিল। এখন কেউ দেখে বলবে, ওটা বসত ভিটে? নদীর বাঁধ ভেঙে জল ঢুকেছে। এখন কোথায় যাব?’’ আশঙ্কা ঝরে পড়ল তাঁর কথায়। ছায়রার চোখের কোণ ভিজে যাচ্ছিল বার বার। আঁচলের খুট দিয়ে মুছে ফের বললেন, ‘‘আমার সারাটা দিন বাঁধে বসে থেকেই কেটে গেল। এখন নতুন করে ঘর বাঁধার ইচ্ছা থাকলেও সামর্থ নেই।’’ আরও জানিয়ে দিলেন, ‘‘সরকারি সাহায্যের আশাও আর করি না।’’
সন্তানকে নিয়ে ছায়রা খাঁ। (ছবি:অর্চিষ্মান সাহা)
আরও পড়ুন: আমপানের তুমুল তাণ্ডবে লন্ডভন্ড নানা জেলা, কোথায় কতটা ক্ষতি দেখে নিন
বিধ্বংসী ঝড়, সঙ্গে প্রবল বৃষ্টি আর জলোচ্ছ্বাস, এই ত্র্যহস্পর্শে তছনছ হয়ে গিয়েছে দক্ষিণ ও উত্তর ২৪ পরগনার বিস্তীর্ণ অংশ। আমপানের তাণ্ডবে ধ্বংসস্তূপের চেহারা নিয়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগনার কুলতলি, কৈখালি, নগেনাবাদ, মৈপীঠ, পূর্ব গুড়গুড়িয়ার মতো এলাকাগুলি। উপড়ে গিয়েছে বিদ্যুতের খুঁটি। বড় বড় গাছ মাটিতে পড়ে রয়েছে। ঝড় আসছে খবর পেয়ে কেউ আধপাকা ধান গোলায় তুলতে পেরেছেন। কিন্তু অনেকেই সেই সময় পাননি। ফলে জলের তলায় চলে গিয়েছে পুরো জমির ফসল। বিপর্যয় যেন থাবা বসিয়েছে এখানকার ঘরে ঘরে।
মাতলার দাপটে ভেঙেছে দেবীপুরের রাস্তা। (ছবি:অর্চিষ্মান সাহা)
এ দিন সকালে এলাকার ক্ষয়ক্ষতি পরিদর্শনে বেরিয়েছিলেন দেউলবাড়ি দেবীপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান নিখিল বৈদ্য। তিন বারের পঞ্চায়েত সদস্য নিখিল আয়লার সময় ছিলেন সিপিএমে। রাজ্যে পালাবদলের পর তিনি চলে যান তৃণমূলে। এ দিন উপপ্রধানকে সামনে পেয়েই ক্ষোভ উগরে দেন গ্রামবাসীরা। তাঁদের অভিযোগ, ১১ বছর আগে আয়লার সময়ে বাড়ি তৈরি করে দেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তা এখনও মেলেনি। অথচ একের পর এক বিপর্যয় ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে তাঁদের জীবনে।
আমপান চলে গিয়েছে। কিন্তু এখনও ফুঁসছে মাতলা। কিছু জায়গায় বাঁধ ভেঙেছে। এ সব দেখেই ফের ভয় দানা বাঁধছে নদীর পারের বাসিন্দাদের মনে। সে সব আশঙ্কা চেপে রেখেই জিয়াউল হতাশ গলায় বললেন, ‘‘ভেসে ভেসেই তো জীবনটা কেটে গেল!’’