Insurance

বিমার ‘প্যাঁচে’ টাকা অধরা 

অভিযোগ, যে সময় সবচেয়ে প্রয়োজন বিমার টাকা, তখনই তা প্রায় অমিল। 

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০২০ ০৫:২৯
Share:

প্রতীকী ছবি

করোনা চিকিৎসায় স্বাস্থ্য বিমা বা করোনা কবচ বিমা, দু’টি ক্ষেত্রেই টাকা পেতে চূড়ান্ত হয়রানির শিকার হচ্ছেন গ্রাহকরা। অভিযোগ, যে সময় সবচেয়ে প্রয়োজন বিমার টাকা, তখনই তা প্রায় অমিল।

Advertisement

সরকারি বিমা সংস্থা ইউনাইটেড ইন্ডিয়া ইনস্যুরেন্স-এর শোভাবাজার শাখায় ‘করোনা কবচ’ পলিসি করাতে চেয়েছিলেন বরাহনগরের বাসিন্দা বছর ষাটের সমীর কুমার পাল। অভিযোগ, তাঁর পলিসি করা যাবে না বলে জানিয়ে দেওয়া হয়। ওই শাখার ডিভিশন ম্যানেজার পুলিনবিহারী দাস এ বিষয়ে বলেন, ‘‘৬০-এর বেশি বয়সিদের করোনা কবচ একেবারে করা যাবে না এমন বলিনি। কিন্তু আমাদেরও একটু বুঝে চলতে হচ্ছে। ৬০ এর বেশি বয়সিদের করোনা হলে জটিলতা বৃদ্ধি পায় ও বেশিদিন হাসপাতালে থাকার আশঙ্কা বাড়ে।’’ তাঁর আরও বক্তব্য, ‘‘কন্টেনমেন্ট জোনের লোকেদের ক্ষেত্রেও আমাদের কন্ট্রোলিং অফিস থেকে এই পলিসি করাটা একটু এড়িয়ে যেতে বলা হয়েছে। বরাহনগর কন্টেনমেন্ট এলাকার মধ্যে পড়ছে।’’

এই সংস্থার ম্যানেজার চন্দ্রাণী মহলানবীশের দাবি, ‘‘কন্টেনমেন্ট জোন নিয়ে এমন কোনও নির্দেশিকা আমাদের নেই। তবে আইআরডিএ-র নির্দেশিকা অনুযায়ী, ৬৫ বছরের বেশি বয়সিরা ‘করোনা কবচ বিমা’ করতে পারবেন না। তাঁদের সাধারণ মে়ডিক্লেম থাকলে তার আওতায় করোনার চিকিৎসা করাতে হবে।’’

Advertisement

কিন্তু স্বাস্থ্যবিমা অধিকার আন্দোলন কর্মী চন্দন ঘোষাল জানাচ্ছেন, সাধারণ মেডিক্লেমে আবার করোনার চিকিৎসা হলে অধিকাংশ বিমা সংস্থা পিপিই-র- খরচ দিচ্ছে না। করোনা কবচে রুম রেট-এর দরের কোনও ঊর্ধ্বসীমা থাকে না। এই সুবিধা থেকেও ৬৫ বছরের বেশি বয়সিরা বঞ্চিত হচ্ছেন। অথচ, এঁদের ‘হাই রিস্ক’ গ্রুপে ধরা হয়।

আরও পড়ুন: মুকুলের ‘ফেরা’র গুঞ্জনে তৃণমূল মুখপাত্রের ইন্ধন

স্বাস্থ্য বিমা সংস্থাগুলি জানাচ্ছে

প্র: করোনা কবচ কারা কিনতে পারবেন?

উ: ১৮-৬৫ বছর বয়সিরা। পলিসির মেয়াদ পূর্তির পরে যদি গ্রাহকের বয়স ৬৫ বছর পেরিয়ে যায়, তিনি আর নতুন করে পলিসি কিনতে পারবেন না। তবে কিছু বিমা সংস্থা মেয়াদ শেষের আগেই পলিসি নবীকরণের সুযোগ দিচ্ছে। সেই সব ক্ষেত্রে নবীকরণের সময়ে বিমাকারীর বয়স ৬৫ বছরের বেশি হলেও বিমার সুযোগ পাবেন। ১৮ বছরের কম বয়সিদের ক্ষেত্রেও শর্তসাপেক্ষে
ব্যক্তিগত করোনা বিমা করা যাবে।

প্র: বিমার অঙ্ক?

উ: ন্যূনতম ৫০,০০০ টাকার বিমা। প্রতি ধাপে তা ৫০,০০০ টাকা করে বাড়ানো যাবে। সর্বাধিক মূল্য ৫ লক্ষ টাকা।

প্র: ৬০ বছরের বেশি বয়সের কেউ করোনা কবচ পলিসি কেনার আবেদন করলে বিমা সংস্থা প্রত্যাখ্যান করতে পারে?

উ: বিমা নিয়ন্ত্রক আইআরডিএ-র নির্দেশিকা অনুযায়ী, পারে না। কারণ, বয়স ১৮ থেকে ৬৫ বছরের মধ্যে হলে পলিসি কিনতে আবেদন করার যোগ্য। ফলে ৬০ বছরের কাউকে বিমা সংস্থা যদি বলে পলিসি করা যাবে না, তা হলে তার কারণও সংশ্লিষ্ট আবেদনকারীকে লিখিত ভাবে জানাতে বাধ্য তারা। প্রয়োজনে আবেদনকারী বিমা সংস্থার বিরুদ্ধে আইআরডিএ-র কাছে অভিযোগ করতে পারেন (irda.gov.in পোর্টালে ঢুকে ‘গ্রিভান্স’ লিঙ্কে ক্লিক করে লিখিত অভিযোগ)।

প্র: আবেদনকারী কনটেনমেন্ট এলাকার বাসিন্দা হলে পলিসি কেনার আবেদন নাকচ করা যায়?

উ: নাকচ করার প্রশ্নই নেই। কনটেনমেন্ট এলাকার বাসিন্দাদের পলিসি বিক্রি করা যাবে না, এমন কোনও কথা আইআরডিএ-র নির্দেশিকায় লেখা নেই। তা ছাড়া, আজ যে অঞ্চল কনটেনমেন্ট জোন, ক’দিন পরে তা সংক্রমণমুক্ত হতে পারে। আবার কোনও গ্রাহক পলিসি কেনার পরে তাঁর এলাকা কনটেনমেন্ট হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে।

প্র: সাধারণ স্বাস্থ্য বিমা পলিসিতে পিপিই কিট বা আনুষঙ্গিক সামগ্রী বাবদ খরচ দেওয়া হয়?

উ: সাধারণত দেওয়া হয় না। তবে কিছু সংস্থা সাধারণ বিমা পলিসিতে সীমিত সংখ্যক পিপিই কিট, দস্তানা বা মাস্কের খরচ দেয়। করোনা কবচে এই খরচ পুরোটাই দেওয়া হয়।

প্র: আবেদনকারীর কোমর্বিডিটি থাকলে, করোনা কবচ কেনার আবেদন ফেরানো যায়?

উ: করোনা কবচে কোমর্বিডিটির খরচ দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে আগে থেকেই যাঁদের গুরুতর অসুখ রয়েছে, তাঁদের পলিসি কেনার আবেদন ফেরানো যাবে কি না, সে ব্যাপারে আইআরডিএ-র নির্দেশিকায় কিছু লেখা নেই। সাধারণ স্বাস্থ্য বিমা পলিসিতে প্রি-এগ্‌জ়িস্টিং ডিজ়িজ়ের ক্ষেত্রে তার খরচ পলিসি কেনার পরে সাধারণত ৪ বছর পেরোলে পাওয়া যায়। কিন্তু করোনা কবচের ক্ষেত্রে পলিসি কেনার ১৫ দিনের পর থেকেই খরচ পাওয়ার কথা। ফলে যে আবেদনকারী বিশেষ গুরুতর অসুখে ভুগছেন (যেমন, ডায়ালিসিস চলে যদি), তাঁদের পলিসি কেনার আবেদন অনেক সময় গ্রহণ না-ও করা হতে পারে। এমন ক্ষেত্রে আবেদন ফেরানোর কারণ সংস্থাটিকে লিখিত ভাবে আবেদনকারীকে জানাতে হবে। সেই ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট না-হলে আইআরডিএ-র কাছে অভিযোগ জানানো যাবে।

প্র: করোনা সংক্রমণের মাত্রা কম হওয়া সত্ত্বেও কেউ যদি হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা করান, করোনা কবচ পলিসির টাকা পাবেন?

উ: আইআরডিএ-র নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, সংক্রমিত হওয়ার প্রমাণ হিসেবে পলিসিহোল্ডারকে সরকারি পরীক্ষাগারের দেওয়া করোনা পজ়িটিভ রিপোর্ট দেখাতে হবে। তা হলেই চিকিৎসার খরচ পাবেন। এমনকি হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা করালেও পাবেন। তবে অতি কম মাত্রায় সংক্রমণের ক্ষেত্রে কেন্দ্র ও রাজ্য বাড়িতে থেকে চিকিৎসা করানোর পরামর্শ দিচ্ছে। আর অনেক সময় হাসপাতালগুলি অপ্রয়োজনে রোগীকে ভর্তি করিয়ে মোটা অঙ্কের বিল করছে। তা আপত্তিজনক। সংক্রমণের মাত্রা মাঝারি বা বেশি হলে সব ক্ষেত্রেই খরচের পুরো টাকা দেওয়া হয়। আইআরডিএ-র নির্দেশিকায় চিকিৎসার খরচ পাওয়ার ক্ষেত্রে ভাইরাস সংক্রমণের মাত্রার প্রভেদ করা হয়নি।

আবার কারও উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবিটিস, হৃদরোগের মতো অন্য অসুখ (কো-মর্বিডিটি) থাকলে বেশির ভাগ বিমা সংস্থা করোনা কবচ পলিসি করছে না অথবা করলেও প্রিমিয়াম অনেক বাড়িয়ে দিচ্ছে। সাধারণ স্বাস্থ্যবিমাতেও প্রিমিয়াম এত বাড়ানো হয়েছে যে, বয়স্কদের অনেকে তা টানতে না পেরে শেষ বয়সে ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন।

অন্য সমস্যাও আছে। ১৭ জুলাই দমদম মতিঝিলের বাসিন্দা বছর পঁয়তাল্লিশের সুবীর বক্সি করোনা-আক্রান্ত হয়ে ডিশান হাসপাতালে ভর্তি হন। স্টার হেলথ ইনসিওরেন্সের আওতায় তাঁর ৫ লক্ষ টাকার মেডিক্লেম ছিল। তিন বছর ধরে প্রিমিয়াম দিয়েছেন। কিন্তু ১ দিন আইসিইউ ও ৫ দিন সাধারণ শয্যা মিলিয়ে মোট ৬ দিন হাসপাতালে থাকার পর বিমা সংস্থা তাঁর ‘ক্লেম’ নাকচ করে দেয়। বিমা সংস্থার দাবি, যে মাত্রায় করোনা হয়েছিল, তার চিকিৎসা বাড়িতে থেকেই করা যেত। সুবীরবাবুর বক্তব্য, ‘‘হাসপাতাল কি তা হলে শুধু-শুধু আমাকে ৬ দিন ভর্তি রেখে ১ লক্ষ ৬৭ হাজার টাকা বিল করল?’’ ডিসানের তরফে তাপস মুখোপাধ্যায়ের মন্তব্য, ‘‘হাসপাতালে ভর্তির দরকার না থাকলেও অনেক করোনা রোগী জোর করে ভর্তি হন। আমরা নিরুপায়। রোগী ভর্তি হলে প্রোটোকল মেনে আমাদের সব টেস্ট করতেই হবে। ন্যূনতম ৬ দিন ভর্তিও রাখতে হবে। তাতে এটুকু বিল স্বাভাবিক।’’

কিন্তু স্টার হেলথ ইনস্যুরেন্সের তরফে চিকিৎসক প্রবীর মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘কলকাতার অধিকাংশ হাসপাতাল এই খেলা চালাচ্ছে। যে সব করোনা রোগী ভর্তি করার কথাই নয় তাঁদের বুঝিয়ে ভর্তি করে ৬, ৭ দিন রেখে দেড়-দু’লক্ষ বিল করে তবে ছাড়ছে। আমাদের কাছে যখন চিকিৎসার কাগজ যাচ্ছে, তখন রোগী ভর্তির কারণ ব্যাখ্যা করতে পারছে না হাসপাতাল। ক্লেম আটকে যাচ্ছে।’’

কোভিড চিকিৎসায় স্বাস্থ্যবিমার অসুবিধা যেখানে

কোভিড কবচ পলিসি


• ৬৫ বছরের বেশি বয়সিরা করতে পারবেন না

• বিভিন্ন বিমা সংস্থা বিভিন্ন প্রিমিয়াম চার্জ করছে

• ক্যানসার, কিডনির সমস্যা, ডায়াবিটিস ইত্যাদি থাকলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই পলিসি করার অনুমতি মিলছে না

• কিছু সংস্থা আবার কো-মর্বিডিটি থাকলেও এই পলিসি দিচ্ছে কিন্তু প্রিমিয়াম বাড়াচ্ছে প্রায় দ্বিগুণ

• এই পলিসি মাত্র সাড়ে ন’ মাসের। এর পরে কি করোনা আর থাকবে না?

• সর্বোচ্চ ৫ লক্ষ টাকার বিমা করা যায়। অনেকেরই কোভিড চিকিৎসায় তার বেশি খরচ হচ্ছে

সাধারণ স্বাস্থ্যবিমা

•পিপিই ও কনজিউমেবলস-এর খরচ অধিকাংশ সংস্থা দিচ্ছে না

•রুম রেটে ক্যাপিং আছে

•অকারণে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। হোম কোয়রান্টিনে থাকলেই হত বলে দাবি করে বহু ক্লেম নাকচ হচ্ছে

•হোম কোয়রান্টিনে কোনও হাসপাতালের প্যাকেজে থাকলেও টাকা মিলবে না

•পলিসি নেওয়ার এক মাসের মধ্যে করোনা হলে টাকা মিলছে না অনেক ক্ষেত্রে

(জরুরি ঘোষণা: কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের জন্য কয়েকটি বিশেষ হেল্পলাইন চালু করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এই হেল্পলাইন নম্বরগুলিতে ফোন করলে অ্যাম্বুল্যান্স বা টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত পরিষেবা নিয়ে সহায়তা মিলবে। পাশাপাশি থাকছে একটি সার্বিক হেল্পলাইন নম্বরও।

• সার্বিক হেল্পলাইন নম্বর: ১৮০০ ৩১৩ ৪৪৪ ২২২
• টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-২৩৫৭৬০০১
• কোভিড-১৯ আক্রান্তদের অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-৪০৯০২৯২৯)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement