প্রতীকী ছবি।
কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি ফিরতে হবে হাকিমপাড়ার দেবব্রত বিশ্বাসকে। ট্রেন জোটেনি কপালে। ঠিক করলেন, বাসেই যাবেন। সন্ধ্যা সাতটায় ধর্মতলা থেকে উঠলেন বাসে। ১২ ঘণ্টার নির্ধারিত যাত্রা। পরের দিন সকাল ৭টায় পৌঁছে যাওয়ার কথা। পরে দেবব্রত বলেন, ‘‘এই পথে নিত্য যাতায়াত করলে জানা যায়, এই ১২ ঘণ্টার পথ পার হতে আদতে কত ঘণ্টা লাগে!’’ বাতানুকূল ঝাঁ চকচকে বাসে হেলান দিয়ে বসে সারাটা পথ সেই অপেক্ষাই করেছেন দেবব্রতবাবু। শেষে ডালখোলায় পাক্কা দেড় ঘণ্টা দাঁড়িয়ে বেলা সাড়ে দশটায় শিলিগুড়ি পৌঁছয় বাস। তাঁর কথায়, ‘‘ডালখোলার যানজটে ৬-৭ ঘণ্টা আটকে থাকাও নতুন কিছু নয়। তাই সে দিন নিজেকে ভাগ্যবানই মনে হয়েছিল।’’
এ সব করোনাকালের আগেকার কথা। করোনার সময়ে প্রায় সব যাত্রী-ট্রেন বন্ধ। ফলে ডালখোলা দিয়ে যাওয়া সংকীর্ণ জাতীয় সড়কের উপরে রেলগেট পড়ে গেলে যে অবস্থা পোহাতে হয়, তা এখন তুলনায় কম হওয়ার কথা। কিন্তু তাতে কি যাত্রার ঝক্কি কিছু কমেছে? কারণ, শুধু জট নয়, পথে খন্দও বড় বিপদের সঙ্কেত দেয়।
মালদহ জেলায় ঢুকে গাজলের ময়না পর্যন্ত প্রায় ৬৮ কিলোমিটার জাতীয় সড়কের অর্ধেকই বেহাল। কোথাও ছোটবড় গর্ত। কালিয়াচকের একাংশে এখনও সম্প্রসারণ শেষ হয়নি। ফলে এই সব এলাকায় দুর্ঘটনার আশঙ্কাও বেশি। গত তিন বছরের হিসেব খুঁজে দেখা যাবে, ২০১৮ সালে ৯৬টি দুর্ঘটনা ১০৪ জন, ২০১৯ সালে ১২২টি দুর্ঘটনায় ১২৮ জন এবং এ বছর অগস্ট পর্যন্ত ৭১টি দুর্ঘটনায় ৭৫ জন মারা গিয়েছেন মালদহে।
জেলার রাজ্য সড়কগুলির হাল কী? ভুক্তভোগীদের কথায়, মালদহ-মোথাবাড়ি, মালদহ-মানিকচক ও মালদহ-নালাগোলা রাজ্য সড়কের একাংশ বেহাল। ফলে এই এলাকায় দুর্ঘটনা লেগেই আছে। কিন্তু সংখ্যাটা জাতীয় সড়কের থেকে অনেক কম। তথ্য বলছে, ২০১৮-য় মালদহে রাজ্য সড়কগুলি মিলিয়ে মোট ৬৫টি দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছিল ৬৮ জনের, ২০১৯ সালে ১০৪টি দুর্ঘটনায় মৃত্যু ১০৯ জনের এবং চলতি অগস্ট পর্যন্ত ৩৫টি দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ৩৮ জনের।
প্রশাসনের কথায়, জাতীয় সড়কের হাল বেশি খারাপ। এই নিয়ে জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠকও হয়েছে। পরিস্থিতির কথা মেনে নিয়ে মালদহের ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের প্রকল্প আধিকারিক দীনেশ হানসারিয়া বলেন, ‘‘আর্থিক কারণে এইচসিসি সংস্থা কাজ করতে পারছে না। তারা শেয়ার বিক্রি করবে। আমাদের তরফে এনওসি দেওয়া হয়েছে। নতুন সংস্থা দায়িত্ব পেলে রাস্তা মেরামতের কাজ শুরু হবে।’’ পাশাপাশি রাজ্য সড়কের ক্ষেত্রে বেহাল দশা কাটাতে টেন্ডার ডাকা হয়েছে। করোনা ও তার পরে বর্ষার জন্য কাজ শুরু হয়নি বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন।
ভুক্তভোগীরা জানেন, উত্তরবঙ্গে জাতীয় সড়কগুলি শহরের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। সেটা যেমন মালদহে, তেমনই ডালখোলা বা ইসলামপুরেও। আরও এগোলে শিলিগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, কোচবিহারেও একই ছবি দেখা যায়। যানজট সামলাতে একাধিক শহরে বাইপাস তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। মালদহে বাইপাসের কাজ এখনও ১৫ শতাংশ বাকি। যদিও রাস্তা খুলে দেওয়া হয়েছে। কিছু জায়গায় বাইপাসের অবস্থা এত খারাপ যে অভিযোগ, সে কারণেও দুর্ঘটনা ঘটছে। ইসলামপুরে দীর্ঘদিন ধরে বাইপাসের কাজ আটকে ছিল জমি জটে। ডালখোলাতেও রেলপথের উপর দিয়ে উড়ালপুল করা যাবে কিনা, তাই নিয়ে ভাবনাচিন্তা রয়েছে।
মালদহ ছাড়িয়ে উত্তর দিনাজপুরে ঢুকলে ইটাহার থেকে চোপড়া পর্যন্ত প্রায় দেড়শো কিলোমিটার জাতীয় সড়কের কোথাও খানাখন্দ, কোথাও আবার পিচের চাদর উঠে বেরিয়ে পড়েছে ইট। বাসিন্দাদের অভিযোগ, ইটাহারের শ্রীপুর, দুর্গাপুর, রায়গঞ্জের রূপাহার, সোহারই, পানিশালা এলাকার ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কে অসংখ্য গর্ত। করণদিঘি থানার নাগর, বিলাসপুর, বোতলবাড়ি ও ডালখোলা থানার বিভিন্ন এলাকাতেও একই হাল। চাকুলিয়া, গোয়ালপোখর, ইসলামপুর ও চোপড়া থানার বিভিন্ন এলাকার ৩১ নম্বর জাতীয় সড়কেও বহু গর্ত। শুধু ইসলামপুর শহরেই এখন জাতীয় সড়ক বড় বড় গর্তে ছয়লাপ।
ডালখোলায় যানজটের জেরে রোজ বহু গাড়ি এখন সংলগ্ন রাজ্য সড়ক ধরে যাতায়াত করে। অভিযোগ, তাতে বোতলবাড়ি থেকে সোলপাড়া ও রসাখোয়ার শিলিগুড়িমোড় থেকে ধনতলা পর্যন্ত রাস্তাও ভাঙতে শুরু করেছে। জেলা বাস ও মিনিবাস সংগঠনের সম্পাদক প্লাবন প্রামাণিক বলেন, ‘‘এই রাস্তায় গাড়ি বিগড়োয়, দুর্ঘটনার আশঙ্কাও বাড়ে।’’ উত্তর দিনাজপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট শুভ্রজিৎ গুপ্ত বলেন, ‘‘প্রশাসনের তরফে কয়েক মাসে জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষকে পাঁচ বার চিঠি পাঠিয়ে রাস্তা স্থায়ী মেরামত করার অনুরোধ করা হয়েছে। এখনও পর্যন্ত সেই কাজ শুরু হয়নি।’’ স্থানীয় বাসিন্দা থেকে বাসচালক, সকলেরই বক্তব্য, তুলনায় রাজ্য সড়কগুলির অবস্থা ভাল। তবে সে সব রাস্তা সংকীর্ণ হওয়ায় দুর্ঘটনায় আশঙ্কা অনেক বেশি।