প্রতীকী ছবি।
স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বদলি-সমস্যার সুরাহায় ‘উৎসশ্রী’ পোর্টাল চালু করেছে রাজ্য সরকার। কিন্তু এখন অন্য একটি ঘোরতর সমস্যার উৎস হয়ে উঠেছে সেই উৎসশ্রী। ওই পোর্টালে আবেদন করে গ্রাম ছেড়ে শহরে আসার জন্য শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মধ্যে এমনই তাড়াহুড়ো পড়ে গিয়েছে যে, গ্রামের বহু স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষিকার অভাব দেখা দিচ্ছে।
অভিযোগ, ব্যাপক বদলির জেরে গ্রামের অনেক স্কুলে এখন বেশ কিছু বিষয়ের শিক্ষকই নেই। ফলে সমস্যা হচ্ছে পঠনপাঠনে। ওই সব স্কুলের প্রধান শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বক্তব্য, গ্রামীণ এলাকায় বেশির ভাগ পড়ুয়াই সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলের উপরে নির্ভরশীল। কিন্তু বদলির ফলে বহু শিক্ষকপদ ফাঁকা হয়ে যাওয়ায় স্কুলগুলির অস্তিত্বই পড়ছে প্রশ্নের মুখে। কিছু স্কুলের প্রধান শিক্ষক-শিক্ষিকাদের আশঙ্কা, করোনা-পরবর্তী পর্যায়ে স্কুল খুললে শিক্ষকের অভাবে স্কুল চালানো মুশকিল হয়ে পড়বে।
বীরভূমের নানুরের একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা মনীষা বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, তাঁদের ১২০০-র মতো ছাত্রী আছে। অথচ তাদের জন্য ১২ জন শিক্ষিকাও নেই। যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে দু’জন শিক্ষিকা সম্প্রতি উৎসশ্রীর মাধ্যমে বদলি হয়ে গিয়েছেন। অন্য দুই শিক্ষিকা বদলির জন্য আবেদন করেছেন। মনীষাদেবী বলেন, ‘‘এ-রকম চললে এক সময় দেখা যাবে, বিষয়-ভিত্তিক শিক্ষিকাই নেই। উৎসশ্রী পোর্টালের মাধ্যমে বদলিতে সব শিক্ষক-শিক্ষিকা যদি শহরমুখী হয়ে পড়েন, করোনার পরে স্কুল চালাতেই সমস্যা হবে।’’ ওই জেলারই ইন্দাস গ্রাম পঞ্চায়েতের একটি স্কুলের এক শিক্ষিকা জানান, উৎসশ্রীর মাধ্যমে বদলি হয়ে যাওয়ায় তাঁদের স্কুলে এখন অঙ্কের কোনও শিক্ষক নেই। তাঁর প্রশ্ন, এ ভাবে স্কুল চলবে কী করে?
দক্ষিণ ২৪ পরগনার সুন্দরবন এলাকার একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক প্রণয় মণ্ডল বলেন, ‘‘এমনিতেই আমাদের স্কুলের শিক্ষকের শূন্য পদ ১২টি। এর মধ্যে আবার উৎসশ্রীর মাধ্যমে শহরে বদলি হয়ে গিয়েছেন চার জন শিক্ষক।’’ মুর্শিদাবাদের বেলডাঙার একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা ফিরোজা বেগম জানান, তাঁদের দু’জন শিক্ষিকা উৎসশ্রীর মাধ্যমে শহরে বদলি হয়েছেন। তাঁদের স্কুলে এখন উচ্চ মাধ্যমিকে ভূগোল পড়ানোর শিক্ষিকা নেই। প্রধান শিক্ষিকা বলেন, ‘‘এমন অনেক স্কুলের কথা জানি, যেখান থেকে ৮-১০ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা উৎসশ্রীর মাধ্যমে অন্য স্কুলে চলে গিয়েছেন। গ্রামের ওই সব স্কুল তা হলে চলবে কী ভাবে?’’
বহু শিক্ষক-শিক্ষিকার বক্তব্য, শহরে অনেক বেসরকারি স্কুলে পড়ার সুযোগ আছে। কিন্তু গ্রামগঞ্জের ছেলেমেয়েদের প্রধান ভরসা সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুল। সেখানে বেসরকারি স্কুল নেই বললেই চলে। এই অবস্থায় গ্রামগঞ্জের স্কুলে যদি শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যা কমে যায়, সেখানে নিয়মিত পঠনপাঠনে সমস্যা হবে।
শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী, শিক্ষানুরাগী ঐক্য মঞ্চের রাজ্য সম্পাদক কিঙ্কর অধিকারী অবশ্য বলছেন, ‘‘উৎসশ্রীর মাধ্যমে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের বদলি অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল। এটি দীর্ঘ কালের দাবি। বর্তমানে গ্রামীণ স্কুলে শিক্ষক বা শিক্ষাকর্মীর যে-সঙ্কট দেখা দিয়েছে, তার জন্য দায়ী নিয়মিত নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন না-করা। নিয়োগ থমকে আছে বহু দিন ধরে। এসএসসি-র মাধ্যমে ফের নিয়মিত নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করতেই হবে।’’
তবে এসএসসি বা স্কুল সার্ভিস কমিশনের আধিকারিকদের বক্তব্য, শিক্ষক-শিক্ষিকারা শুধু গ্রাম থেকে শহরেই যাচ্ছেন না। শহর থেকে গ্রামেও যাচ্ছেন। এসএসসি-র পরামর্শদাতা পার্থ কর্মকার বলেন, ‘‘শহরের অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকার বাড়ি গ্রামে। তাঁরা বাড়ির কাছাকাছি গ্রামীণ স্কুলে চলে যাচ্ছেন। গ্রামের স্কুলে যে-সব পদ শূন্য আছে বা শূন্য হচ্ছে, সেখানে দ্রুত নিয়োগ হবে।’’