বিজেপির প্রশ্নে আপসহীন অবস্থান নিতে চাইছে সিপিএম। —গ্রাফিক শৌভিক দেবনাথ।
আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের আশঙ্কা ছিল, বহু জায়গায় সিপিএমের প্রতীকে জেতা লোকজন পঞ্চায়েতের বোর্ড গঠনের সময়ে বিজেপিকে সমর্থন করে দিতে পারেন। ভোটের আগে এ নিয়ে দলের মধ্যে কড়া বার্তাও দিয়েছিলেন সিপিএম রাজ্য নেতৃত্ব। কিন্তু জেলায় জেলায় দলের সেই ‘নির্দেশিকা’ উড়িয়ে সিপিএমের টিকিটে জেতা বহু পঞ্চায়েত সদস্য বিজেপিকে সমর্থন করেছেন। কোথাও কোথাও ক্ষমতার বৃত্তে থাকার মানসিকতা নিয়ে শাসকদল তৃণমূলের পাশেও দাঁড়িয়েছেন তাঁরা।
তবে সিপিএম তাঁদের রেয়াত করছে না। দলীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, জেলায় জেলায় তত্ত্বতালাশ করে এখনও পর্যন্ত যে তথ্য পাওয়া গিয়েছে, তাতে দলের কয়েকশa নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক পদক্ষেপ করা হচ্ছে। কোথাও তা ‘বহিষ্কার’। কোথাও আবার ‘শোক়জ়’ বা ‘সাসপেনশন’। সিপিএম পঞ্চায়েত ভোটের আগে থেকেই প্রকাশ্যে বলা শুরু করেছিল, বিজেপির সঙ্গে কোনও আপস তারা মানবে না। ভোটের পর সে কথা কাজে করে দেখাতে চাইছে আলিমুদ্দিন স্ট্রিট। অর্থাৎ, তারা নীতির প্রশ্নে ‘আপস’ করতে নারাজ। সেই প্রেক্ষিতেই সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তীর প্রশ্ন, ‘‘আমরা তো সাংগঠনিক ভাবে যা পদক্ষেপ করার করছি। কিন্তু যেখানে তৃণমূল-বিজেপি মিলিজুলি বোর্ড গঠন করেছে, সেখানে এই দু’দল কী করবে?’’
বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর জেলা বলে পরিচিতি পূর্ব মেদিনীপুরে এখনও পর্যন্ত আট জনকে বহিষ্কার করেছে সিপিএম। শোকজ় করা হয়েছে প্রায় ১৫০ জনকে। হুগলিতে ইতিমধ্যেই দল থেকে তাড়ানো হয়েছে পাঁচ জনকে। আরও বেশ কিছু নেতাকর্মী দলের আতশকাচের নীচে রয়েছেন বলে দলীয় সূত্রেই জানা গিয়েছে। একই ঘটনা নদিয়া-সহ অন্যান্য জেলাগুলিতেও ঘটেছে। তবে সিপিএম নেতৃত্বকে বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে দলের কাঠামোর বাইরে থাকা লোকজনকে নিয়ে। যাঁরা দলের সদস্য নন, তাঁদের বিরুদ্ধে কোনও সাংগঠনিক পদক্ষেপ করা যাচ্ছে না। সেই সব জায়গায় লিফলেট ছড়িয়ে মানুষকে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে দলের কোনও যোগাযোগ নেই।
এমন যে হতে পারে, তা আগে থেকে অনুমান করেই একাধিক জেলায় বোর্ড গঠনের দিন জয়ী সদস্যদের পঞ্চায়েত অফিসের দিকে না যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল সিপিএম। দলের হুগলি জেলা সম্পাদক দেবব্রত ঘোষ বলেন, ‘‘যেখানে আমরা সংখ্যা অর্জন করতে পেরেছি, কেবল সেখানেই গিয়েছি বোর্ড গঠনের দিন। বাকি জায়গায় পরে শপথ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এই ধরনের ঘটনা এড়াতেই আমরা দলে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।’’ কিন্তু আরামবাগ মহকুমায় কিছু জায়গায় তা মানা হয়নি বলেই জেলা সিপিএম সূত্রে খবর।
আবার নদিয়ার জেলা সম্পাদক সুমিত দে বলেন, ‘‘জেলার ১৮৫টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে ১২০টিতে আমাদের প্রতিনিধি রয়েছেন। এই ১২০টির মধ্যে আবার ১৮ থেকে ২০টি পঞ্চায়েত এলাকায় বিজেপিকে সমর্থন করা বা করার জন্য মদত দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে। সব অভিযোগ সমান নয়। গোটাটাই দলের নজরে রয়েছে। যেখানে সরাসরি যোগের প্রমাণ রয়েছে, সেখানে সংশ্লিষ্ট সদস্যকে বহিষ্কার করা হচ্ছে। যেখানে সরাসরি প্রমাণ নেই, সেখানে শোকজ় করা হচ্ছে। তবে আমরা স্পষ্ট বলে দিয়েছি, যিনি যে স্তরেরই নেতা হোন না কেন, বিজেপি যোগের প্রমাণ মিললে শাস্তি পেতেই হবে।’’
২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে দেখা গিয়েছিল বামেদের ভোট কার্যত উজাড় করে রামের বাক্সে গিয়েছে। সেই ধারা অব্যাহত ছিল ২০২১-এর বিধানসভা ভোটেও। কিন্তু তার পর থেকে কিছুটা হলেও সিপিএম তথা বামেরা ভোট বাড়িয়েছে। শান্তিপুর থেকে বালিগঞ্জ বিধানসভার উপনির্বাচন, পুরভোট বা পঞ্চায়েত ভোট— রামের থেকে বামের বাক্সে ভোট অনেকটাই ফেরত এসেছে। যা আবার বিজেপির জন্য খুব একটা শুভ সঙ্কেত নয়। সাগরদিঘি উপনির্বাচনে বামেদের সমর্থনে কংগ্রেস প্রার্থী হিসাবে বাইরন বিশ্বাসের জয় রাজনৈতিক মহলকে আন্দোলিত করে দিয়েছিল। তার পরেই সিপিএম অনেকটা ‘আত্মবিশ্বাসী’ হয়ে ওঠে। মহম্মদ সেলিমের নেতৃত্বে তারা আবার সংগঠন গোছানোর দিকে মন দিয়েছে। পঞ্চায়েতের ভোট পরবর্তী এই প্রক্রিয়া তারই অংশ। যেখানে নীতির প্রশ্নে ‘আপস’ না-করে বিজেপির সঙ্গে মাখামাখি করলে কঠোর পদক্ষেপ করা হচ্ছে। অনেকের মতে, সিপিএম এই ধরনের পদক্ষেপের মধ্যে দিয়ে আসলে দূরে সরে যাওয়া বামমনস্ক মানুষজনকে বার্তা দিতে চাইছে। একদা রাম যোগের ‘পাপ’ও ধুতে চাইছেন সিপিএম নেতৃত্ব। তবে এই ‘সাংগঠনিক দৃঢ়তা’ দেখাতে গিয়ে লোকসভার আগে দলের শাস্তিপ্রাপ্ত অংশকে বিজেপির দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে বলেও মনে করছেন সিপিএমের অনেকে।