ব্রিগেডে ডিওয়াইএফআইয়ের সভায় বক্তব্য রাখছেন মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।
মেয়েটাকে একটু ডেকে দেন না গো দাদা!
এক ঝটকায় শুনলে মনে হবে, আগন্তুক হয়তো নিজের মেয়েকে খুঁজছেন। কিন্তু গঙ্গারামপুর থেকে আসা মুখ কাতর কণ্ঠে আসলে কাকে খুঁজছে, এই ব্রিগেড ময়দানে দাঁড়ালে পরক্ষণেই বুঝে ফেলা যায়। দেখা করবেন কেন? এই পরের প্রশ্নে জবাব এল, ‘‘চুরি-লুটে সব তো শেষ হয়ে গেল। পিঠ সোজা করে লড়ছে মেয়েটা। হাতে দু’শোটা টাকা দিয়ে যাব।’’ ক্ষেতমজুরির কাজ করে যাঁর সংসার চলে, দু’শো টাকা মানে তাঁর কাছে অনেক।
লোকসভা নির্বাচনের বছরের প্রথম রবিবার দুপুরে ব্রিগেড সমাবেশ উপলক্ষে কলকাতা শহরের প্রায় দখল নিয়েছিল এমনই অজস্র খেটে-খাওয়া মুখ। যে কোনও রাজনৈতিক সমাবেশের উদ্যোক্তা দলই সংগঠিত ভাবে লোক নিয়ে আসার কিছু ব্যবস্থা করে। ডিওয়াইএফআইয়ের ডাকে এ বারের সমাবেশেও তার ব্যতিক্রম ছিল না। কিন্তু সেই আয়োজনকে দৃশ্যতই ছাপিয়ে গেল গ্রাম-গঞ্জ, মফস্সল থেকে নিজেদের মতো করে সমাবেশে চলে আসা একেবারে সাধারণ জনতার আধিক্য। যাদের অনেকে ট্রেনের পরিষেবায় গোলমাল আছে বলে বাস, এমনকি নৌকোর ব্যবস্থা করে হাজির হয়েছে। যারা ছুটির দিনের দুপুরে চিড়িয়াখানা যাবে বলে ব্রিগেড ছেড়ে তড়িঘড়ি বেরিয়ে গেল না। মাঠে ঠায় বসে থাকল এবং ডিওয়াইএফআইয়ের রাজ্য সম্পাদক মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়ের হাতে দেওয়ার জন্য রোজগারের টাকা থেকে যথাসাধ্য সাহায্য রেখে গেল। সাম্প্রতিক কালের কোনও ব্রিগেড সমাবেশে এমন দৃশ্য বেশ বিরল।
সিপিএম নেতৃত্বের একাংশের ভাবনা ছিল, সমাবেশের ডাক লাল ঝান্ডার তরফে দেওয়া হলে কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে যে উদ্দীপনা থাকে, সাদা পতাকায় (যুব ও ছাত্র সংগঠনের পতাকার রং সাদা) তেমনটা কী হবে? দিনের শেষে ভিড়ের বহরে তাঁরা আশ্বস্ত। আরও বেশি স্বস্তি জনতার চেহারা ও মেজাজে। সব্জি বিক্রেতা তাঁর এক দিনের বিক্রির টাকা দিয়ে যাচ্ছেন, কোনও ক্রমে দিন গুজরান করা মহিলা মুঠোয় ধরা সামান্য টাকা তুলে দিয়ে লড়াই চালিয়ে যেতে বলছেন— ডিওয়াইএফআই এবং সিপিএম রাজ্য নেতৃত্বের কাছে বড় প্রাপ্তি এটাই। বামেদের সমাবেশে ভিড় হয় কিন্তু ভোট আসে না, এই নিয়ে এখনও চর্চা বিস্তর। তবে সিপিএম নেতৃত্বের আশা, নিজেদের চেষ্টায় এসে যে সাধারণ, গরিব মানুষ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন, ভোটের বাক্সে তাঁরা সঙ্গেই থাকবেন। শ্রেণি বিন্যাসের নিরিখেও বামেদের জন্য এ বারের ব্রিগেড ‘বেনো জল’ মুক্ত!
ক্যানিং থেকে আসা সমীর দাসের কথায়, ‘‘একটা দল চুরি-ডাকাতি করছে। আর একটা দলও বড়লোকের। তারাও কাজ দিচ্ছে না, জাত-পাত করছে। এর মধ্যে মীনাক্ষীরা লড়াইটা করছে।’’ তাঁদের কথার সূত্রেই মীনাক্ষী বলছেন, ‘‘কোচবিহার থেকে যখন ‘ইনসাফ যাত্রা’ শুরু হয়েছিল, তখন ক’টা লোক ছিল আর এখন কত লোক! এই ব্রিগেডে লড়াইয়ের একটা ধাপ (হার্ডল) পেরোলাম আমরা। অনেক মানুষ এসেছেন কিন্তু সংখ্যার চেয়ে বড় কথা মেজাজ। তাঁরা লড়াই চান। এত লোক যেমন পারছেন টাকা দিয়ে যাচ্ছেন মানে ভরসা রাখছেন। এঁদের সঙ্গে বেইমানি করতে আমরা কিছুতেই পারব না!’’
রাজ্যের শাসক দলে যখন প্রবীণ বনাম নবীনের তুলকালাম দ্বন্দ্ব চলছে, সেই সময়ে সিপিএম তাদের মতো করে প্রজন্মান্তরও সেরে ফেলেছে। ব্রিগেডে এ দিন মাঠে দর্শকাসনে বসে থেকেছেন বিমান বসু, সূর্যকান্ত মিশ্র, সুজন চক্রবর্তীরা। মঞ্চ ছেড়ে দেওয়া হয়েছে মীনাক্ষী, ধ্রুবজ্যোতি সাহা, কলতান দাশগুপ্ত, সৃজন ভট্টাচার্যের মতো তরুণ প্রজন্মের জন্য। আবার মীনাক্ষী এনেছেন তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মের প্রসঙ্গ। তাঁর কথায়, ‘‘মইদুলকে (নবান্ন অভিযানে পুলিশের হাতে ‘আক্রান্ত’ হয়ে নিহত মইদুল মিদ্দা) এখনও চোখের সামনে দেখতে পাই। সুদীপ্ত, সৈফুদ্দিনদের লাশ কাঁধে করে নিয়ে এসেছি। লাশকাটা ঘরের গন্ধটা নাকে লেগে আছে। যারা ওদের মেরেছিল, তাদের ছেড়ে দিলে পরবর্তী প্রজন্ম আমাদের বেইমান বলবে।’’
সভা শেষ করে মাঠে নেমে আসার পরেও সিপিএমের যুব নেত্রীকে ঘিরে হইচই চলছিল কয়েক দঙ্গল প্রান্তিক মানুষের। যা দেখে মনে পড়তেই পারে, এক সময়ে বামেদের স্লোগান ছিল গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরো। মীনাক্ষীকে সেতু করে কি আবার গ্রাম এবং খেটে-খাওয়া মানুষকে নতুন করে ছোঁয়ার চেষ্টা হল?