সাংবাদিক বৈঠকে মেয়র অশোক ভট্টাচার্য।— নিজস্ব চিত্র।
কয়েক মাস আগে শিলিগুড়ির পুরভোট পথ দেখিয়েছিল সব বিরোধীদের একজোট হয়ে শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার। এ বার সেই শিলিগুড়িই ফের পথ দেখাল কংগ্রেস এবং বামেদের সমঝোতার। বিধানসভা নির্বাচনের আগে যাকে ‘দ্বিতীয় শিলিগুড়ি মডেল’ বলছেন কেউ কেউ। তৃণমূলের মোকাবিলা করতে গেলে উত্তরবঙ্গের পথই গোটা রাজ্যে অনুসরণ করা উচিত বলে স্বর জোরালো হতে শুরু করেছে বাম ও কংগ্রেস সুই শিবিরেই।
বিভিন্ন এলাকায় সমবায় সমিতি, স্কুলের পরিচালন সমিতির ভোটে শাসক-বিরোধী অলিখিত জোট এর মধ্যে দেখা গিয়েছে। এ বার কয়েক ধাপ এগিয়ে খানিকটা বৃহত্তর ক্ষেত্র অর্থাৎ শিলিগুড়ি পুরসভাতেও তৃণমূলকে হারাতে খোলাখুলি কংগ্রেসকে সমর্থন করতে দেখা গেল সিপিএমকে। শিলিগুড়ি পুরসভার ১০ আসন বিশিষ্ট ৩ নম্বর বরোয় তৃণমূল ও বামেদের চারটি করে আসন ছিল। মাত্র দু’জন কাউন্সিলর কংগ্রেসের। অথচ শুক্রবার ভোটাভুটিতে তৃণমূল প্রার্থীকে ৬-৪ ভোটে হারিয়ে কংগ্রেসের কাউন্সিলর সুজয় ঘটক চেয়ারম্যান পদ দখল করেছেন। মাত্র তিন দিন আগেই ধর্মতলার সমাবেশে দাঁড়িয়ে বিরোধীদের ‘হ য ব র ল’ বলে আক্রমণ করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিরোধীরা বা বাম-কংগ্রেস একজোট হলে যে শাসক দলের বিপদ হবে, সেই আশঙ্কা থেকেই আক্রমণে গিয়েছিলেন তৃণমূল নেত্রী। শিলিগুড়িতে অশোক ভট্টাচার্য়ের দল এ দিন প্রমাণ করে দিল, তৃণমূল নেত্রীর আশঙ্কার কারণ সত্যিই আছে!
শিলিগুড়িতে অবশ্য বাম-কংগ্রেস সমঝোতা নতুন নয়। বছর ছয়েক আগে বামেদের সমর্থনে সেখানে তৃণমূলের মেয়র পদপ্রার্থী গৌতম দেবকে হারিয়ে বোর্ড গড়েছিল কংগ্রেস। দু’মাস আগেই নির্দলকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে পুরবোর্ড গড়েছে বামেরা। সদ্যসমাপ্ত বাজেট অধিবেশনে কংগ্রেস কাউন্সিলরেরা সংশোধন সাপেক্ষে পুর-বাজেটকে সমর্থন করেছেন। তার পরেই বরো নির্বাচনে বামেদের সমর্থনে কংগ্রেসের চেয়ারম্যান পদপ্রাপ্তিকে ‘দ্বিতীয় শিলিগুড়ি মডেল’ হিসাবেই দেখা হচ্ছে। শিলিগুড়ির মেয়র অশোকবাবুর বক্তব্য, ‘‘পুরসভার বরোর ভোটাভুটিতে কক্ষ সমন্বয় করতে হয়। এটা কোনও নির্বাচনী জোট বা সমঝোতা নয়।’’ একই সঙ্গে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অশোকবাবুর সংযোজন, ‘‘তবে এটা জোর গলায় বলতে পারি, রাজ্যের যেখানে তৃণমূলকে হারানোর ন্যূনতম সুযোগ মিলবে, সেখানেই তার সদ্ব্যবহার করব! রাজ্যের স্বার্থেই তৃণমূল-বিরোধী ধর্মনিরপেক্ষ সব দলকে সমন্বয় করতে হবে।’’ কংগ্রেসের সদ্য নির্বাচিত বরো চেয়ারম্যান সুজয়বাবুর বক্তব্য, ‘‘ বাম ও তৃণমূল থেকে সমদূরত্বের নীতির কথা মাথায় রেখে প্রার্থী দিয়েছি। বামেরা আমাদের সমর্থন করেছেন। উন্নয়নই আমাদের লক্ষ্য।’’
বস্তুত, সিপিএম বা কংগ্রেস কোনও দলই রাজ্য স্তরে জোট বা সমঝোতার ব্যাপারে কোনও আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নেননি। আপাতত স্থানীয় স্তরের হাতে বিষয়টি ছেড়ে দিয়ে তাঁরা দেখতে চাইছেন, নিচু তলার মনোভাব কী। শিলিগু়ড়ির মডেল
সফল হলে নিঃসন্দেহে রাজ্য স্তরেও দু’দলের উপরে চাপ বাড়বে কাছাকাছি আসার জন্য। প্রদেশ কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নান যেমন এ দিনই শিলিগুড়ির মডেলকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, ‘‘একেবারেই ঠিক সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই পথেই এখন যাওয়া উচিত।’’ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী অবশ্য প্রত্যাশিত ভাবেই বিষয়টিকে স্থানীয় স্তরের সিদ্ধান্ত বলে বর্ণনা করেছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘পঞ্চায়েত বা পুরসভায় অনেক ক্ষেত্রেই তৃণমূল-বিজেপি-সিপিএম সব মিলেমিশে বোর্ড চালিয়েছে। এটাও স্থানীয় স্তরের সিদ্ধান্ত। এর সঙ্গে রাজ্যে দল হিসাবে জোট বা নির্বাচনী সমঝোতার কোনও সম্পর্ক নেই।’’ শিলিগুড়ির পরিপ্রেক্ষিত খতিয়ে না দেখে তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে মুখ খুলতে চাননি সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র। যদিও দলের একটি সূত্রের বক্তব্য, রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অশোকবাবু দলের অনুমোদন ছাড়া কিছু করেননি। আর অশোকবাবু নিজেও কংগ্রেসের সঙ্গে কৌশলগত সমঝোতার অন্যতম প্রবক্তা।
তৃণমূল প্রত্যাশিত ভাবে ‘অনৈতিকতা’ দেখছে। উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেবের কথায়, ‘‘এটা অনৈতিক আঁতাত! দলনেত্রী যে হ য ব র ল-র কথা বলেছিলেন, তার সূচনা শিলিগুড়ি থেকে হল!’’ যদিও তৃণমূলের বিরুদ্ধে বিজেপি-র সহায়তা পাওয়ার অভিযোগ তোলার সুযোগ পেয়ে গিয়েছে বামেরা। সেটাও শিলিগুড়িতেই! শিলিগুড়ি পুরসভায় ৫টি বরোর মধ্যে কাউন্সিলর সংখ্যার নিরিখে বাম এবং তৃণমূল উভয়েরই একটি করে বরো দখল নিশ্চিত ছিল। বাকি তিনটি বরো কার দখলে যাবে, সে জল্পনা চলছিল।
শিলিগুড়ির ১০ আসন বিশিষ্ট দু’নম্বর বরোয় তৃণমূলের দখলে রয়েছে ৫টি আসন। সিপিএমের দু’টি, কংগ্রেস, বিজেপি ও নির্দলের দখলে একটি করে আসন। সেখানে তৃণমূল ও কংগ্রেস প্রার্থী দিলেও সিপিএম দেয়নি। বিজেপি কাউন্সিলর পুরসভার হাজির হলেও ভোটে যোগ দেননি। ভোটাভুটিতে ৫-৪ জিতেছেন তৃণমূল প্রার্থী জিতেছেন। অর্থাৎ বিজেপি-র ভোট না দেওয়ার ফায়দা তৃণমূল পেয়েছে। কংগ্রেসের সুজয়বাবুর কটাক্ষ, ‘‘দু’নম্বর বরোয় বিজেপি ভোটাভুটি থেকে সরে গিয়ে তৃণমূলকে সুবিধা করে দেওয়ায় অনেক কিছু সামনে এসেছে। যেমন, সারদা-কাণ্ড কেন ধামাচাপা পড়ে গিয়েছে তা কিছুটা বোঝা যাচ্ছে। ২০১৬-র বিধানসভা ভোটে তৃণমূলকে ময়দান ছাড়ার যে ইঙ্গিত বিজেপি দিয়েছে, তারও প্রতিফলন যেন দেখা গেল শিলিগুড়ির বরো চেয়ারম্যান ভোটে!’’ যদিও বিজেপি-র জেলা সভাপতি রথীন বসুর দাবি, ‘‘আমরা তৃণমূলের পাশে দাঁড়াইনি। সে জন্যই তো আমাদের কাউন্সিলর ভোটে যোগ দেননি।’’ কিন্তু তাতে কি তৃণমূলের সুবিধা হল না? রথীনবাবুর মন্তব্য, ‘‘কী হলে কী হতে পারত, এ সব প্রশ্নের জবাব দেব না!’’