প্রতীকী ছবি।
পারদেওনাপুরের কাছে গঙ্গা সামান্য বাঁক নিয়েছে। স্থানীয়রা বলেন— ওটাই নদীর বাংলাদেশে ঢোকার সঙ্কেত। তার কাছে পারলালপুর ঘাট থেকেই এত দিন স্রোতে ভাসিয়ে দেওয়া হত গরুর পাল। কলার ভেলা বেঁধে দেওয়া হত শরীরে, যাতে ডুবে না-যায়। গত বছর পর্যন্ত এই ভাবেই চলে এসেছে পাচার।
কিন্তু এই বছর এ পারে বলতে গেলে অদৃশ্য সেই ‘ভাসমান গরুর দল’। কেন? প্রশ্ন শুনে পারলালপুর ঘাট লাগোয়া রাধামাধব মন্দিরের দিকে আঙুল তুলে দেখাচ্ছেন স্থানীয়রা। তার কাছেই হয়েছে নতুন বিএসএফ ক্যাম্প। মালদহের কালিয়াচক ৩ নম্বর ব্লকের এই এলাকা থেকে বাংলাদেশ বলতে গেলে ঢিল ছোড়া দূরত্বে, পুবে পা বাড়ালেই। তা সে গঙ্গা ধরেই যাওয়া হোক বা জমির আলপথ। আর দক্ষিণে গঙ্গা পার হলে মুর্শিদাবাদের ধুলিয়ান ও নিমতিতা।
গোয়েন্দাদের সন্দেহ, বছরের পর বছর এই এলাকা দিয়ে গরু পাচারের রাশ ছিল মুর্শিদাবাদের ব্যবসায়ী মহম্মদ এনামুল হকের হাতে। এর মধ্যে ২০১৫ সালে ২০ নম্বর ব্যাটেলিয়নে যোগ দেন সহকারী কমান্ডান্ট সতীশ কুমার। ছিলেন ২০১৭ সাল পর্যন্ত। তবে দ্রুত তিনি ওই ব্যাটেলিয়নের (তত দিনে তা নাম বদলে হয়ে গিয়েছে ৩৬ নম্বর ব্যাটেলিয়ন) কমান্ডান্ট হয়ে যান। সেই সময়ে প্রচুর গরু উদ্ধার হয়েছিল। প্রশ্ন উঠেছে, গরু যদি উদ্ধারই হয়, তা হলে সতীশের নাম কী ভাবে জড়াল পাচারের সঙ্গে?
স্থানীয় ওয়াকিবহাল লোকজন থেকে প্রশাসনের একটি অংশের কথায়, গরু উদ্ধারই হল চোখে ধুলো দিয়ে পাচারের ব্যবস্থা করা। কারণ, উদ্ধার হওয়া গরু সরকারের তরফে আবার নিলাম করা হত। সেটা তখন কিনে নিত পাচারকারীরাই। নিলাম থেকে কেনার ফলে সরকারি কাগজপত্রও এসে যেত হাতে। অভিযোগ, এখানেও প্রচুর গরুকে বাছুর হিসেবে দেখিয়ে বিক্রি করা হত। সরকারি হিসেব বলছে, ২০১৫ সালে যেখানে আড়াইশোর কম গরু উদ্ধার হয় মালদহ ও মুর্শিদাবাদের লাগোয়া এলাকা থেকে, ২০১৬ সালে সংখ্যাটা ছাপিয়ে যায় ছ’শো। পরের বছর একেবারে ১০৬৮। সতীশ চলে যেতেই সংখ্যা নেমে আসে সাড়ে চারশো থেকে ছ’শোর মধ্যে।
এ বারে দু’টো কারণে মালদহ দিয়ে গরু পাচার কমেছে, দাবি প্রশাসনের। প্রথমত, বিএসএফের কড়াকড়ি। তারা যেমন পারলালপুর ঘাটে ক্যাম্প করেছে, তেমনই পারদেওনাপুর-শোভাপুরের অন্দরে ঢুকে টহল দিচ্ছে নিয়মিত। বাংলাদেশের গা ঘেঁষে থাকা কালিয়াচক ৩ ব্লকের এই এলাকাই ছিল পাচারকারীদের স্বর্গরাজ্য, বলছে প্রশাসনের একটি অংশ। দ্বিতীয় কারণ লকডাউন। এর প্রথম দিকে ঘর থেকে বার হওয়াও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এলাকার লোকজনের। সেই সময়ে পাচারও কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। কালিয়াচকে যেমন বিএসএফের নতুন ঘাঁটি হয়েছে, তেমনই হবিবপুরের আইহো এবং সংলগ্ন যাদবনগর, সুখনগর, চাঁদপাড়া, আইহো হাইস্কুলের পাশ দিয়ে অলিগলিতে এখন সীমান্তরক্ষী বাহিনীর নিয়মিত টহল চলছে। আইহো-তে এগোলেই যে মহানন্দা, যার ওপারে বাংলাদেশ। একই ভাবে পেট্রলগড়, রঞ্জিতপুর, বৈদ্যপুর, আগ্রা হরিশ্চন্দ্রপুর সীমান্তে পুনর্ভবা নদী পার হলেও ওপার বাংলা। প্রশাসনের এক আধিকারিক বলেন, ‘‘খেয়াল করুন, বেশিরভাগই কিন্তু নদী সীমান্ত। সেখানে নদীতে টহল থাকে, কিন্তু কাঁটাতার থাকে না। তাই গরু ভাসিয়ে পাচার করা সোজা।’’ এ ছাড়াও বামনগোলার থানার আদাডাঙা, খুটাদহ এবং হবিবপুরের ইটাহাটি, কেদারিপাড়ায় রয়েছে উন্মুক্ত সীমান্ত। নদীপথ ব্যবহার করা হয় বর্ষায়, আর উন্মুক্ত সীমান্ত দিয়ে শীতে কুয়াশার সাহায্য নেয় পাচারকারীরা। কালিয়াচকের ষষানি, মিলিক, সুলতানপুর এলাকায় বেপরোয়া পাচারকারীরা কাঁটাতার কেটেও গরু পাঠিয়েছে ওপারে।
এ বছর এখন পর্যন্ত মালদহ ও সংলগ্ন মুর্শিদাবাদ থেকে গরু উদ্ধারের সংখ্যা ২৩৪। এর মধ্যে গঙ্গার দক্ষিণ প্রান্তেই অধিকাংশ। তবে মালদহেও বেশ কিছু জায়গায় গরু উদ্ধার হয়েছে। একটি ক্ষেত্রে তো দেখা যায়, মৃত জন্তুর চামড়ার ভিতরে একটি বাছুরকে রেখে পাচারের চেষ্টা হচ্ছিল। প্রশাসনের কর্তারা বলছেন, তা বলে মনে করবেন না এনামুলের প্রভাব এ পারেও কিছু কমেছে। তার সাঙ্গোপাঙ্গরা সব আপাতত গা ঢাকা দিয়েছে। তাদের কেউ কেউ থাকে ইংরেজবাজারের কমলাবাড়ি, কেউ কেউ আইহোতেও। এনামুলের সংস্থা আপাতত মালদহের মহদিপুর সীমান্ত দিয়ে পাথর, পেঁয়াজ, চাল আমদানি-রফতানি করছে।
এই চক্র নিয়ে তদন্ত শুরু হতেই প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী অভিযোগের আঙুল তোলেন শাসকদলের নেতাদের দিকে। প্রশাসনের অন্দরেও উঠে আসে বেশ কয়েকটি নাম। মালদহ জেলা তৃণমূল সভানেত্রী মৌসম নুর সাফ বলেন, ‘‘পাচারের সঙ্গে আমাদের দলের কোনও সম্পর্ক নেই। যদি সুনির্দিষ্ট কোনও অভিযোগ আসে তবে দল অবশ্যই পদক্ষেপ করবে। তবে সীমান্তের পুরো বিষয় দেখে বিএসএফ। ফলে তাঁরাই বলতে পারবে সীমান্তে কী হয়।’’ গৌড়বঙ্গের অন্য দুই জেলার তৃণমূল সভাপতি গৌতম দাস ও কানাইয়ালাল আগরওয়ালও বল ঠেলে দিয়েছেন বিএসফের কোর্টে। একই কথা শোনা গিয়েছে দক্ষিণ দিনাজপুরের পুলিশ সুপার দেবর্ষি দত্তের মুখেও। তবে মালদহের পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়া বলেন, ‘‘পুলিশও খোঁজ রাখছে।’’
বিএসএফের কেউ মুখ খুলতে চাননি। বাহিনীর এক কর্তা শুধু বলেন, “সীমান্তে কড়া নজরদারি রয়েছে। আমরাও সতর্ক রয়েছি।”