থিকথিকে: পশ্চিম বর্ধমানের নিয়ামতপুরের একটি পুকুরে ছটপুজো উপলক্ষে ভিড়। উধাও দূরত্ব-বিধি। অনেকে পরেননি মাস্কও। ছবি: পাপন চৌধুরী
ঠাসাঠাসি ভিড়। মাস্ক বেপাত্তা। করোনা-আবহে ছটপুজোয় কার্যত ছুটি পেল স্বাস্থ্যবিধি! খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হোক, বা স্থানীয় পুলিশ-প্রশাসনের— আবেদন, সতর্কবাণী, প্রচার কানে তোলার লোক কম পড়ল। নিষিদ্ধ শব্দবাজি ফাটানো, তারস্বরে বক্স বাজানোর ছবিও মিলেছে বিস্তর। বুধবার গোটা রাজ্যের এই ছবি আজ, বৃহস্পতিবারেও বজায় থাকে কি না, তা নিয়ে আশঙ্কায় পরিবেশকর্মী এবং ডাক্তারেরা।
শহর কলকাতায় সুভাষ বা রবীন্দ্র সরোবরের মতো জাতীয় সরোবরকে বুধবার ছটের জনতার থেকে দূরে রাখা গেলেও, এলাকায় এলাকায় তৈরি ছোট জলাশয়গুলির চারপাশে জড়ো হওয়া জনতাকে করোনা-বিধি পালন করানো যায়নি বলে অভিযোগ। দেদার নিষিদ্ধ বাজি ফাটার অভিযোগও উঠেছে। আরজিকর হাসপাতালের সামনে আবার গাড়িতে বড় সাউন্ডবক্স লাগিয়ে পুজোমুখী জনতাকে যেতে দেখা গিয়েছে বলে দাবি প্রত্যক্ষদর্শীদের।
মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য ছটপুজোর অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে কোভিড-বিধি মেনে চলতে আবেদন জানিয়েছেন। এ দিন বিকেলে তিনি তক্তাঘাট ও দইঘাট পরিদর্শন করেন। মঞ্চে উঠে মমতা বলেন, ‘‘কোভিড-বিধি মেনে ছটপুজো পালন করুন। মাস্ক অবশ্যই পরুন।’’
কিন্তু রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে বিধি মানার নজির দেখা যায়নি বললেই চলে। উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি, মালদহে ছটপুজোর জন্য নির্দিষ্ট ঘাটে বিধি না-মানা ভিড় ছিল। রায়গঞ্জ, বালুরঘাট, গঙ্গারামপুরের নানা ঘাটে শোনা গিয়েছে ডিজের তাণ্ডব। নিষিদ্ধ শব্দবাজি পুড়েছে শিলিগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, কোচবিহারে। শিলিগুড়ির পরিবেশকর্মী অনিমেষ বসুর মন্তব্য, ‘‘সন্ধ্যা পর্যন্ত যা বাজি পুড়েছে বা শব্দ বিধিভঙ্গ হয়েছে, তা সূচনা মাত্র। রাত বাড়লে বাজিও বাড়ে। আশঙ্কায় আছি।’’
আশঙ্কার কারণ অবশ্য শুধু উত্তর নয়, দক্ষিণবঙ্গেও ছিল অঢেল। পূর্ব বর্ধমানে দুপুরের পর থেকেই দামোদর নদের ঘাটে জমা হওয়া ভিড়ে দূরত্ববিধি মানার বালাই ছিল না বলে অভিযোগ। বিকেল থেকে বক্স বাজিয়ে রাস্তায় নাচতে নাচতে উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁর থানার ঘাটে পুজো দিতে জড়ো হয় জনতা। অনেকেরই মুখে মাস্ক ছিল না। একই পরিস্থিতি দেখা গিয়েছে হাবড়ায়। পুলিশের নজরদারি ছিল না বলে অভিযোগ। মুর্শিদাবাদের বহরমপুরের গোরাবাজার ও খাগড়ায় ভাগীরথীর বিভিন্ন ঘাটে ছটপুজোর ভিড়ে ‘মাস্ক কোথায়’ প্রশ্ন করা হলে কেউ আঁচলে মুখ ঢেকেছেন, কেউ মুখ লুকিয়েছেন রুমালে। দুপুর থেকে ডিজে, বক্সের উৎপাত চলেছে নদিয়ার রানাঘাটে। বীরভূমের রামপুরহাট, নলহাটিতে মাস্ক ছাড়া ভক্তদের ভিড়ে দেখা গিয়েছে প্রবীণ থেকে শিশুকে।
পশ্চিম মেদিনীপুরের খড়্গপুর শহর, পশ্চিম বধর্মান, বাঁকুড়া, পুরুলিয়াতেও ছবিটা আলাদা নয়। ‘বাঁকুড়া শহর ছটপূজা কমিটি’র সভাপতি দিলীপ আগরওয়ালের দাবি, “দীর্ঘদিন কার্যত ঘরবন্দি থাকার পরে ছটপুজোয় মানুষের উচ্ছ্বাস বাঁধ ভেঙেছে।’’
খড়্গপুরের পুরপ্রশাসক প্রদীপ সরকারের বক্তব্য, “করোনা-বিধি মানা হল কি না, সেটা পুলিশ-প্রশাসন দেখবে। মানুষের জন্য উৎসব। নিষেধ তো করা যাবে না। তবে সবাইকে করোনা-বিধি মেনে চলতে মাইকে প্রচার করছি।”
আবার রানিগঞ্জের ‘পণ্ডিতপুকুর ছট কমিটি’র তরফে দীপু গোপ, উত্তম গোপদের অভিজ্ঞতা, “যথাসাধ্য সচেতনতা প্রচার করছি। পর্যাপ্ত মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজ়ার রাখা হলেও, মানুষ সে সবের ধার ধারছেন না।” আসানসোল-দুর্গাপুরের পুলিশ কমিশনার সুধীরকুমার নীলাকান্তম বলেন, “আমাদের কাছে এ বিষয়ে অভিযোগ আসেনি। তবে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।”
হাওড়া গ্রামীণ এলাকার উলুবেড়িয়া, বাউড়িয়া, চেঙ্গাইলের গঙ্গার ঘাটে করোনা-বিধি উড়িয়ে অনেকে ভিড় করেন। তবে উলুবেড়িয়া পুরসভার পক্ষ থেকে গঙ্গার ঘাটে সিসি ক্যামেরায় নজরদারি চালানো হয়। প্রশাসনের তরফে গঙ্গায় নৌকো চেপে টহল চলে। হুগলির বহু ঘাটেই দূরত্ববিধি মানা না হলেও, উত্তরপাড়া, কোন্নগরে পুলিশকে মাইকে মাস্ক পরতে, নিষিদ্ধ বাজি না পোড়াতে প্রচার করতে দেখা গিয়েছে।
রাজ্যের কোভিড মনিটরিং কমিটির পূর্ব ও পশ্চিম বর্ধমানের জেলা কো-অর্ডিনেটর সমরেন্দ্রকুমার বসু বলেন, “কোভিড-পরিস্থিতিতে লাগামছাড়া ভিড় করার অর্থ, বিপদকে যেচে ঘরে ডেকে আনা। অথচ, দেখা যাচ্ছে, নাগরিক অসচেতনতার ছবি।”
ছটপুজো থাকলেও ভাগীরথীতে ভেসে বেড়ানো কুমিরের ভয়ে এ দিন পূর্ব বর্ধমানের পূর্বস্থলী ২ ব্লক এলাকায় ভাগীরথীর বহু ঘাট সুনসান ছিল।