সক্রিয় কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা দেশে কমছে। ব্যতিক্রম দেশের কয়েকটি রাজ্য। তাদের মধ্যে অন্যতম পশ্চিমবঙ্গ। দৈনিক সক্রিয় রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধির তালিকায় এই মুহূর্তে দেশে তৃতীয় স্থানে। বৃহস্পতিবার রাজ্যে সক্রিয় রোগীর সংখ্যা বে়ড়েছে ৪৯৩। তালিকার উপরে রয়েছে ছত্তীসগঢ় (৬৫০) ও কর্নাটক (৯৯০)। এই সক্রিয় রোগী বাড়ার অর্থ সংক্রমণ বৃদ্ধি। কেন এই বৃদ্ধি, তা নিয়ে বেশ কয়েকটি কারণ সামনে উঠে এসেছে। পুজোর বাজার হোক বা অফিসের সময় বাসে বাদুড়ঝোলা ভিড়, তর্পণ করতে গঙ্গার ঘাটের গাদাগাদি বা দূরত্ববিধি না মেনেই জমায়েত। এর উপর সামনে দুর্গাপুজো। সে সময় যদি কোভিড সচেতনতা ভুলে মানুষ ‘উৎসবে’ মেতে ওঠেন, তা হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ দিকে যাবে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।
কলকাতা, দুই ২৪ পরগনা ও হাওড়া— মূলত এই ক’টি জেলাতেই আবদ্ধ ছিল পশ্চিমবঙ্গের করোনা সংক্রমণ। লকডাউন শিথিল হতে তা রাজ্যের অন্যান্য জেলাতেও ছড়াতে শুরু করে। ওই সব জেলাগুলিতে সংক্রমণ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে জেলাগুলিতে সংক্রমণ বৃদ্ধি প্রশাসনেরও কপালে ভাঁজ ফেলছে। আসুন এক নজরে দেখে নিই, রাজ্যের বিভিন্ন জেলার করোনা পরিস্থিতি।
রাজ্যে করোনা পরিস্থিতির কথা এলে প্রথমে উঠবে কলকাতার নাম। মোট আক্রান্ত ও মোট মৃত্যু, দু’টি ব্যাপারেই রাজ্যের শীর্ষে কলকাতা। গত এক মাসে সাড়ে ২১ হাজার নতুন সংক্রমণ হয়েছে কলকাতাতে। মৃত্যুও হয়েছে ৫০০-র বেশি আক্রান্তের।
উত্তর ২৪ পরগনাতেও আক্রান্ত কম হওয়ার কোনও লক্ষণ নেই। গত এক মাসে রাজ্যের মধ্যে সব থেকে বেশি সংক্রমণ হয়েছে এই জেলাতেই। সাড়ে ২২ হাজার মানুষ নতুন সংক্রমণের জেরে এই জেলাতে মোট আক্রান্ত ৫৭ হাজারে পৌঁছেছে। পাশাপাশি এখানে মোট মৃত্যুও ১২০০-র বেশি।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার অবস্থাটা এই দুই জেলার থেকে অবশ্য ভাল। গত একমাসে সংক্রমণ বৃদ্ধি উপরের দুই জেলার থেকে অনেকটাই কম এখানে।
আলিপুরদুয়ারে গত একমাসে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় আড়াই গুণ হয়েছে। সেপ্টেম্বরের শুরুতে সেখানে মোট আক্রান্ত ছিলেন দু’হাজার ১৮১ জন। ৮ অক্টোবর তা দাঁড়িয়েছে পাঁচ হাজার ১৯৩। গত একমাসে দৈনিক সংক্রমণও বেড়েছে উত্তরবঙ্গের এই জেলাতে।
কোচবিহারের ছবিটাও একই রকম। সেখানেও মোট আক্রান্তের সংখ্যা গত একমাসে দ্বিগুণ হয়েছে। এই সময়কালে মৃত্যু ১০ থেকে বেড়ে হয়েছে ৪৩।
এই ধারা অব্যাহত কালিম্পঙেও। সেপ্টেম্বরে শুরুতে সেখানে ৪৮৩ জন আক্রান্ত ছিলেন। এখন সংখ্যাটা এক হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছে।
দার্জিলিং ও জলপাইগুড়িতে আক্রান্ত বৃদ্ধি তুলনায় একটু কম। গত এক মাসে পাঁচ হাজার থেকে বেড়ে সাড়ে আট হাজারে পৌঁছেছে দার্জিলিঙের আক্রান্তের সংখ্যা। ওই জেলাতে মোট মৃত্যুও ১০০ ছাড়িয়েছে।
গত এক মাসে জলপাইগুড়িতেও প্রায় তিন হাজার নতুন সংক্রমণ হয়েছে। উত্তরবঙ্গের এই জেলাতে রোজ ৮০জনের বেশি নতুন করে সংক্রমিত হয়েছেন।
উত্তরবঙ্গের মতো দক্ষিণবঙ্গের বেশ কয়েকটি জেলা নিয়েও চিন্তিত প্রশাসন। সেই তালিকায় প্রথম দিকেই রয়েছে নদিয়া। গত একমাসে এই জেলাতে দ্বিগুণ হয়েছে কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা। চার হাজার থেকে তা প্রায় সাড়ে আট হাজারে পৌঁছেছে। রোজ ১০০-র বেশি লোক আক্রান্ত হচ্ছেন সেখানে।
নদিয়ার মতোই পরিস্থিতি পুরুলিয়া ও বাঁকুড়ায়। পুরুলিয়ায় গত একমাসে আড়াই হাজারেও বেশি মানুষ নতুন করে সংক্রমিত হয়েছেন। সেখানে মোট আক্রান্ত চার হাজার ছুঁই ছুঁই। গত এক মাসে করোনার জেরে বেশ কয়েকটি প্রাণহানিরও সাক্ষী থেকেছে রাজ্যের পশ্চিম প্রান্তের এই জেলা।
বাঁকুড়াতেও পরিস্থিতি একই রকম। সেখানেও গত একমাসে আড়াই হাজার নতুন আক্রান্ত।
সেপ্টেম্বরের শুরুতে ঝাড়গ্রামে মোট আক্রান্ত ছিলেন ২৬৪ জন। এখন তা এক হাজার ছা়ড়িয়েছে। গত এক মাসে সেখানকার মোট আক্রান্ত তিন গুণ বেড়েছে।
১ সেপ্টেম্বর থেকে ৮ অক্টোবর— এই সময়কালে দুই মেদিনীপুরেই নতুন আক্রান্ত পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। তবে পূর্ব মেদিনীপুরের তুলনায় পশ্চিম মেদিনীপুরে মৃত্যু হয়েছে অনেক বেশি। গত এক মাসে পূর্ব মেদিনীপুরে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার জন আক্রান্ত হয়েছেন। মৃত্যু হয়েছে ৮০ জনের।
পশ্চিম মেদিনীপুরে এই সময়কালে আক্রান্ত হয়েছেন সাড়ে পাঁচ হাজারের বেশি। কিন্তু এই সময়কালে ১১৭ জন করোনার জেরে প্রাণ হারিয়েছেন সেই জেলায়।
হুগলি জেলাতেও এই সময়ে আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। সাত হাজার থেকে তা ১৪ হাজারের পৌঁছেছে।
হাওড়াতেও এই সময়কালে ছ’হাজার নতুন সংক্রমণ হলেও সেখানকার অবস্থা আগের তুলনায় ভাল। হাওড়ায় যে হারে নতুন সংক্রমণ হচ্ছিল। গত এক মাসে তা অনেকটাই কমেছে। তবে মোট মৃত্যুর নিরিখে রাজ্যের মধ্যে হাওড়ার স্থান তৃতীয়।
দুই বর্ধমানের পরিস্থিতিও অনেকটা একই রকম। তবে এই সময়কালে পূর্বের তুলনায় পশ্চিম বর্ধমানে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। পূর্ব বর্ধমানে গত এক মাসে ২৭০০-র বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন।
পশ্চিম বর্ধমানে সংখ্যাটা প্রায় চার হাজার। যদিও মোট মৃতের সংখ্যা অন্য রাজ্যগুলির তুলনায় কম দুই বর্ধমানে।
বীরভূমেও আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে এই সময়ে। দু’হাজার থেকে তা প্রায় সাড়ে চার হাজারে পৌঁছেছে।
গত এক মাসে মালদায় অবশ্য করোনা পরিস্থিতির অবনতি হয়নি। নতুন আক্রান্ত বৃদ্ধিও সেখানে আগের থেকে অনেক কম।
তবে মালদার বিপরীত চিত্র দেখা গিয়েছে মুর্শিদাবাদে। সেখানে মোট আক্রান্ত গত এক মাসে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
দুই দিনাজপুরে করোনা পরিস্থিতি বরং আশাব্যঞ্জক। উত্তর দিনাজপুরে গত মাসে নতুন সংক্রমণ হয়েছে ১৬০০-র আশপাশে।
দক্ষিণ দিনাজপুরে তা ১৯০০-র আশপাশে। মৃত্যুর নিরিখে ভাল জায়গায় রয়েছে এই দুই জেলা।
বাস চললেও শুরু হয়নি লোকাল ট্রেন পরিষেবা। সেই পরিস্থিতিতেই জেলায় জেলায় বাড়ছে আক্রান্ত। পুজোর মুখে এই সংক্রমণ বৃদ্ধি নিয়ে যথেষ্ট চিন্তার কারণ রয়েছে বলে জানালেন চিকিৎসক অরিন্দম বিশ্বাস। তাঁর কথায়, ‘‘করোনা নিয়ে সচেতনতার অভাব সর্বত্র। অনেকেই ঠিক মতো মাস্ক পরছেন না। ওনামের জেরে কেরলে কী ভাবে করোনা সুনামি এল, তা আমরা দেখেছি। করোনা পরিস্থিতিকে তোয়াক্কা না করে উৎসবে মাতলে আমাদের কপালেও নেমে আসতে পারে দুর্ভোগ।’’