ছবি: এএফপি।
সচেতনতা বিধি, নমুনা পরীক্ষা থেকে আক্রান্তের ভর্তি প্রক্রিয়া এবং সর্বোপরি ‘হোম আইসোলেশনে’র প্রতিবন্ধকতা— নোভেল করোনাভাইরাসের মোকাবিলায় এই সবক’টি বিষয় আপাতদৃষ্টিতে স্বতন্ত্র। আদতে একটি আরেকটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সেই সম্পর্কের বাঁধনেই বঙ্গে সংক্রমণ বৃদ্ধির কারণ লুকিয়ে রয়েছে বলে মত রাজ্য স্বাস্থ্য পরিষেবার বিভিন্ন স্তরে কোভিড নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে যুক্ত বিশেষজ্ঞদের।
গত রবিবার ১২ জুলাই রাজ্যে একদিনে আক্রান্তের সংখ্যা ১৫০০ ছাড়িয়েছে । ৯ জুলাই এই সংখ্যা ছিল ১০৮৮। পরবর্তী দু’দিন তা ছিল যথাক্রমে ১১৯৮ ও ১৩৪৪। বঙ্গে সংক্রমণ বৃদ্ধির সঙ্গে ভাইরাসের মিউটেশন, তার প্রভাব, একজনের দেহ থেকে কতজন সংক্রমিত হচ্ছেন— এ সবের কি কোনও যোগ রয়েছে? ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োমেডিক্যাল জিনোমিক্সের ডিরেক্টর (এনআইবিএমজি) তথা ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সের (আইআইএসসি) প্রফেসর সৌমিত্র দাসের তত্ত্বাবধানে কলকাতা-সহ এ রাজ্যে ভাইরাসের সিকোয়েন্স নিয়ে গবেষণার কাজ চলছে। সৌমিত্রবাবু জানান, এদেশে একজন আক্রান্ত থেকে ভাইরাস দেড় জনের দেহে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাঁর কথায়, ‘‘মানবদেহে প্রবেশের পরে একেবারে গোড়ার দিকে ভাইরাসের প্রভাব কম থাকে। কিন্তু অ্যাডভান্স স্টেজে বা দেহে ভাইরাসের স্থায়িত্ব বৃদ্ধির সঙ্গে প্রভাবের মাত্রা বাড়ে। ফলে একেবারে গোড়ায় সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে যা ফল মিলবে, চার-পাঁচ দিনের মাথায় একই ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে তার প্রভাব অন্যরকম হতে পারে।’’ অধিকর্তা জানান, ভাইরাসের টাইপ হয়তো এক। কিন্তু রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ক্ষেত্রবিশেষে একজন বৃদ্ধ কাবু হতে পারেন, আবার কেউ হয়তো উপসর্গহীন হয়ে থেকে গেলেন!
এসএসকেএমের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের প্রধান তথা ভাইরাস রিসার্চ ডায়গনিস্টিক ল্যাবরেটরির প্রজেক্ট ডিরেক্টর রাজা রায় বলেন, ‘‘এখন ৩০ শতাংশ উপসর্গযুক্ত হলে ৭০ শতাংশই উপসর্গহীন। সত্যিই যাঁদের প্রয়োজন তাঁরা কতখানি নমুনা পরীক্ষার সুযোগ পাচ্ছেন, সেটাও দেখতে হবে।’’ এসএসকেএমের বিভাগীয় প্রধানের কথায় যা উহ্য রইল তা হল, উপসর্গযুক্ত ব্যক্তিদের যদি সময়ে পরীক্ষা করানো না হয়, তাহলে তাঁদের থেকে সংক্রমিত হওয়ার সংখ্যাও বাড়বে।
সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে প্রশাসনিক পদক্ষেপ ও স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর বিষয়। কলকাতা-সহ জেলার একাধিক পুরসভার স্বাস্থ্য বিভাগের আধকারিকদের বক্তব্য, করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট পজ়িটিভ আসার পরে আক্রান্ত ব্যক্তি স্বাস্থ্য দফতরের একটি ফোন পেতেন। সেই ফোনের মাধ্যমে রোগী কোথায় ভর্তি হবেন, ‘হোম আইসোলেশনে’ থাকলে কী করণীয়, তার উত্তর মিলত। এখন ফোনের অপেক্ষায় আক্রান্তকে হাপিত্যেশ করে থাকতে হচ্ছে বলে অভিযোগ। স্বাস্থ্য দফতরের কন্ট্রোল রমে আক্রান্ত নিজে যোগাযোগ করলে যে সমস্যার সুরাহা হচ্ছে তা-ও নয়। এক আধিকারিকের কথায়, ‘‘স্বাস্থ্য দফতরের নির্দেশ ছাড়া আক্রান্তকে হাসপাতালে ভর্তির ক্ষেত্রেও সমস্যা হচ্ছে। উপসর্গযুক্ত ব্যক্তিরা শয্যা না পেয়ে যদি দু’দিন ঘরেই থাকেন তাহলে সংক্রমণ তো বাড়বেই!’’
আরও পড়ুন: কলকাতায় প্রথম এক দিনে আক্রান্ত ৫০০ ছাড়াল, কন্টেনমেন্ট জোনে বাড়ছে লকডাউনের মেয়াদ
সরকারি-বেসরকারি কোভিড হাসপাতালের চিকিৎসকদের একাংশ জানান, আক্রান্তের ‘ছুটি নীতি’ নিয়েও সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। শয্যার জোগান দিতে গিয়ে এখন দ্রুত রোগীদের ছুটি দেওয়ার উপরে জোর দেওয়া হচ্ছে। সংক্রমণ বৃদ্ধির কারণ হিসাবে কলকাতা পুরসভার জনস্বাস্থ্য বিভাগের এক প্রবীণ চিকিৎসক-আধিকারিক জানান, ‘হোম আইসোলেশনে’ যাঁরা রয়েছেন লোকবলের অভাবে তাঁরা নিয়ম মেনে ঘরে রয়েছেন কি না, তা দেখা সম্ভব হচ্ছে না। সংক্রমণ বৃদ্ধির সেটিও একটি কারণ বলে মত ওই পুর আধিকারিকের।