ছবি সংগৃহীত।
‘স্যর, আপনি কি ডক্সিসাইক্লিন, ডেক্সামেথাসন, মন্টিলুকাস্ট ওষুধ দেবেন?’ রোগীর মুখে এমন প্রশ্ন শুনে হকচকিয়ে গিয়ে চিকিৎসক জানতে চেয়েছিলেন, তিনি কোথা থেকে এ সব জানলেন! রোগীর সপ্রতিভ উত্তর ছিল, “পাড়ায় অনেকেই তো আক্রান্ত হয়েছেন। তাই তাঁদের থেকে জেনে আগেই ওই ওষুধ কিনে রেখেছি।” রোগীর চিকিৎসাবিদ্যায় এমন ‘পারদর্শিতা’ দেখে ডাক্তারবাবু কার্যত বাক্যহারা হয়ে গিয়েছিলেন।
শুধু ওই ডাক্তারবাবু নন, সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ে এ বার এমন ঘটনার সাক্ষী থাকছেন অনেক চিকিৎসকই। যাঁরা সকলেই এই ধরনের ঘটনাতে অক্সিজেন সিলিন্ডারের কৃত্রিম সঙ্কট তৈরির আশঙ্কাও করছেন। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিনের চিকিৎসক অরুণাংশু তালুকদার বলছেন, ‘‘কোভিডের চিকিৎসায় সরকারি প্রোটোকল মেনে ৫-৬ রকমের ওষুধ দেওয়া হয়। মনে রাখতে হবে সমস্ত রোগীর ক্ষেত্রে সব ওষুধ প্রযোজ্য নয়। কিন্তু এক শ্রেণির মানুষ পরিচিতদের থেকে প্রেসক্রিপশন জোগাড় করে আগাম ওষুধ কিনছেন। যা কৃত্রিম ওষুধ সঙ্কট তৈরি করছে।’’
প্রশাসন সূত্রের খবর, রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের প্রোটোকল অনুযায়ী করোনা আক্রান্ত রোগীকে মূলত ট্যাবলেট ডক্সিসাইক্লিন--১০০ মিলিগ্রাম (এমজি), আইভারমেক্টিন-১২ এমজি, ডেক্সামেথাসন--৪/৮ এমজি, মিথাইলপ্রেডনিসোলন--৪/৮/১৬ এমজি, ভিটামিন সি--৫০০ এমজি, জিঙ্ক --৫০ এমজি, মন্টিলুকাস্ট এবং ইনহেলার বুডেসোনাইড--২০০/৪০০ মাইক্রোগ্রাম দেওয়া হচ্ছে। হাসপাতালে থাকা সঙ্কটজনক রোগীকে প্রয়োজনে ইঞ্জেকশন রেমডিসিভিয়ার, টসিলিজ়ুমাব দেওয়া হচ্ছে। বাস্তব পরিস্থিতি বলছে, চাহিদা অনুযায়ী জোগানে টান পরছে ডক্সিসাইক্লিন, ডেক্সামেথাসন, মিথাইলপ্রেডনিসোলন-৪ এবং ৮এমজি ট্যাবলেটের। সূত্রের খবর, ওষুধগুলি হাতেগোনা কয়েকটি সংস্থা তৈরি করে। আচমকাই চাহিদা কয়েক গুণ বাড়ায় সমস্যায় প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলিও।
এক শ্রেণির মানুষের নাছোড়বান্দা মনোভাবই এর জন্য দায়ী বলেই মত ‘বেঙ্গল কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট অ্যাসোসিয়েশন’-এর সভাপতি শঙ্খ রায়চৌধুরীর। তিনি জানান, প্রেসক্রিপশনে হয়তো সাত দিনের ওষুধ লেখা। ক্রেতা এসে চাইছেন এক মাসের ওষুধ! কেউ কেউ মুড়ি-মুড়কির মতো ভিটামিন ও জিঙ্ক কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। শঙ্খ বলেন, ‘‘আচমকা চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। ওই ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলিকেও আমরা বলেছি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওষুধ খোলা বাজারে পাঠাতে। কিন্তু মানুষকেও সচেতন হতে হবে।’’
বাড়িতে করোনার ওষুধ কিনে রেখে, কোভিড না-হলেও তা খেয়ে কোনও লাভ হয় না বলেই জানান জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অনির্বাণ দলুই। তাঁর কথায়, ‘‘করোনাকে প্রতিরোধ করতে কোভিড বিধি মানতে হবে। তার পরেও উপসর্গ দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। নিজে থেকে ওষুধ খাওয়া অনেক সময়ই বিপদ ডেকে আনতে পারে।’’ ‘ইন্ডিয়ান ফার্মাসিউটিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন’-এর রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স কমিটির সদস্য অরিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ না-দেওয়া এবং ঠিক যতটা পরিমাণ লেখা থাকবে তার বেশি যাতে কাউকে ওষুধ না-দেওয়া হয়, সেটার উপর নজর রাখতে হবে।’’
অক্সিজেন সিলিন্ডারের মতো রেমডিসিভিয়ার ও টসিলিজুমাব ইঞ্জেকশনের ক্ষেত্রেও কালোবাজারির অভিযোগ উঠতে শুরু করেছিল। তাই ওই দুটি ওষুধ ব্যবহারে রাশ টানতে ইতিমধ্যেই নির্দেশিকা জারি করেছে স্বাস্থ্য দফতর। বেসরকারি কোভিড হাসপাতাল বা নার্সিংহোমে কতগুলি ক্রিটিক্যাল কেয়ার শয্যা রয়েছে, তাতে কত জন ভর্তি সেই অনুযায়ী প্রস্তুতকারী সংস্থা সরাসরি সংশ্লিষ্ট বেসরকারি হাসপাতালে রেমডিসিভিয়ার ও টসিলিজ়ুমাব পাঠাবে।
করোনার ওষুধের আচমকা এই সঙ্কট তৈরি নিয়ে স্বাস্থ্য দফতরের এক আধিকারিক বলেন, ‘‘বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। ড্রাগ কন্ট্রোলকে নজর রাখতে বলা হয়েছে।’’ তবে ওষুধ বিক্রেতা এবং চিকিৎসকদের একাংশের দাবি, নির্দিষ্ট প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ বিক্রি বন্ধ এবং যথাযথ ভাবে ওষুধ বিক্রি নিয়ে কড়া পদক্ষেপ করতে
হবে সরকারকেই।