প্রতীকী ছবি।
বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো একেই বলে!
জটিল করোনার প্রাণদায়ী ওষুধ ‘রেমডেসিভিয়ার’-এর জোগান স্বাভাবিক রাখতে সরকার নিয়মকানুন যত কড়া করছে, ততই নিয়মের ফাঁক গলে তার কালোবাজারি তুঙ্গে উঠছে। এমনিতে এর ছ’টি ভায়ালের দাম ৩৪০০-৫৪০০ টাকা। কিন্তু অসহায় মানুষের কাছে এক-একটি ভায়ালের জন্য ২৫-৩০ হাজার টাকা দাম হাঁকছেন দালালেরা। ছ’টি ভায়ালের জন্য কোথাও নেওয়া হচ্ছে এক লক্ষ ২০ হাজার টাকা, কোথাও বা দেড় লক্ষ বা এক লক্ষ ৮০ হাজার! প্রিয়জনের প্রাণ বাঁচাতে মরিয়া অনেকেই যেনতেন প্রকারে সেই টাকা জোগাড় করে ওষুধ কিনছেন, অনেকে আবার টাকা দিয়ে প্রতারিতও হচ্ছেন।
প্রশ্ন উঠছে, ওষুধের অযৌক্তিক ব্যবহার বন্ধ করে জোগান স্বাভাবিক রাখতেই তো রেমডেসিভিয়ারের উপরে নিয়মকানুন আরোপ হয়েছে। নজরদারি চালাচ্ছে স্বাস্থ্য দফতর এবং ড্রাগ কন্ট্রোল। গৃহ-নিভৃতবাসে থাকা রোগীদের এই ওষুধ ব্যবহার নিষিদ্ধ হয়েছে। তা হলে ওষুধের জন্য হাহাকার কমার বদলে বাড়ছে কেন? সর্বোপরি রোগীর স্বজনদের দিয়ে এই ওষুধ কেনানোর কথাই নয়। সরকারের নির্দেশ, উৎপাদক সংস্থার থেকে বেসরকারি হাসপাতাল নিজেরা রেমডেসিভিয়ার কিনবে। তা হলে রোগীর আত্মীয়স্বজনকে তা হন্যে হয়ে খুঁজতে হচ্ছে কেন?
একটাই উত্তর। চাহিদার তুলনায় জোগান কম। দেশে মাত্র ছ’টি সংস্থা রেমডেসিভিয়ার উৎপাদন করে। তার বেশির ভাগই মহারাষ্ট্র, উত্তরপ্রদেশ, দিল্লি, মধ্যপ্রদেশের মতো রাজ্যে চলে যাচ্ছে। সংক্রমণ তুঙ্গে ওঠায় পশ্চিমবঙ্গেও বহু মানুষের ওই ওষুধ দরকার। কোনও হাসপাতাল ১০০ ভায়াল চাইলে স্বাস্থ্য দফতর বা ড্রাগ কন্ট্রোল তাদের ৩০টির অনুমোদন দিচ্ছে। ধরা যাক, কোনও হাসপাতালে ১৪০ জন সঙ্কটাপন্ন রোগী আছেন। প্রত্যেকেরই রেমডেসিভিয়ার দরকার। কিন্তু ড্রাগ কন্ট্রোলের নজরদারিতে মাত্র ৯০টি ওষুধ পেয়েছে হাসপাতাল। তা হলে বাকি ৫০ জনের কী হবে?
‘‘আমরা রোগীর পরিবারকে আমাদের অসহায়তার কথা জানাচ্ছি, প্রিয়জনকে বাঁচাতে বাড়ির লোক যে-কোনও ভাবে ওষুধ সংগ্রহের চেষ্টা করছেন। তারই সুযোগ নিচ্ছে কালোবাজারিরা,’’ বলেন হাওড়ার এক বেসরকারি হাসপাতালের কর্তা।
২৮ এপ্রিল কসবা থানায় এমনই এক কালোবাজারির বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেন স্থানীয় বাসিন্দা দেবাঞ্জলি ভট্টাচার্য। তিনি জানান, তাঁর বাঁকুড়াবাসী এক বন্ধুর ক্যানসার-আক্রান্ত মায়ের করোনা হয়েছে। তাঁকে ভর্তি করানো হয় দুর্গাপুরের এক বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে। অভিযোগ, তারা ছ’টি রেমডেসিভিয়ার কিনতে বলে বাড়ির লোককে। বিভিন্ন দিকে খোঁজাখুঁজি শুরু হয়। দেবাঞ্জলিদেবী বললেন, ‘‘এক পরিচিত ব্যক্তি পার্ক সার্কাসের এক জনের ফোন নম্বর দেন। ফোন করলে ৫৪০০ টাকার ওষুধের জন্য তিনি এক লক্ষ ২০ হাজার টাকা চান এবং রাজি থাকলে টাকা নিয়ে কোয়েস্ট মলের সামনে হাজির হতে বলেন। আমরা তখন ১০০ ডায়াল করে লালবাজারে অভিযোগ জানাই। তার পরে কসবা থানায় লিখিত অভিযোগ করি।’’ দেবাঞ্জলিদেবী জানান, অন্য এক জন ৯০ হাজার টাকার বিনিময়ে গিরিশ পার্ক মেট্রো স্টেশনের সামনে থেকে ছ’টি ওষুধ সংগ্রহ করতে বলেন।
একাধিক রোগীর আত্মীয়ের কাছ থেকে একটি নম্বর পেয়ে লেকটাউনের এক ব্যক্তির সঙ্গে আনন্দবাজারের তরফে রোগীর আত্মীয় সেজে ফোন করা হয়েছিল। সেই ব্যক্তি ফোন ধরে হিন্দিতে বলেন, ‘‘সপ্তাহ দুয়েক আগেও অনেক ওষুধ ছিল। এখন কড়াকড়ি বেড়়েছে। দু’টির বেশি ওষুধ দিতে পারব না। এক-একটি ওষুধের জন্য ৩০ হাজার টাকা লাগবে।’’
দিন চারেক আগে অভিযোগ পেয়ে ড্রাগ কন্ট্রোলের কর্তারা অভিযান চালান। পার্ক স্ট্রিটের এক মহিলার খোঁজ মেলে, যিনি একটি অনলাইন ফার্মাসির সঙ্গে যুক্ত। জিজ্ঞাসাবাদের মুখে তিনি স্বীকার করেন, এক জন তাঁকে কিছু রেমডেসিভিয়ার এনে দেবেন বলেছেন। প্রতিটির জন্য ১৮ হাজার টাকা লাগবে। সেগুলি তিনি পরে আরও বেশি দামে বেচবেন। ওই মহিলাকে দিয়ে ফোন করিয়ে সেই ব্যক্তিকে নিউ মার্কেটের সামনে ডেকে পাঠানো হয় এবং ওষুধ দেওয়ার সময় গ্রেফতার করা হয় হাতেনাতে। লোকটি নিউ মার্কেট চত্বরের একটি নামী ওষুধের দোকানের কর্মী এবং তাঁর দেওয়া রেমডেসিভিয়ার বাংলাদেশের। সংশ্লিষ্ট ওষুধের দোকানের মালিকের বক্তব্য, তিনি এর কিছুই জানেন না। অভিযুক্ত কর্মচারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
অ্যাপোলো গ্লেনেগ্লস এবং ক্যালকাটা হার্ট ক্লিনিক জানিয়েছে, তাদের রেমডেসিভিয়ারের অভাব নেই। তবে মারাত্মক আকাল করোনার অন্য গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ টসিলিজুম্যাব, ইটোলিজুম্যাবের। ওগুলো একেবারেই মিলছে না। দুর্গাপুর মিশন হাসপাতাল জানাচ্ছে, তারা যত রেমডেসিভিয়ার চাইছে, পাচ্ছে তার মাত্র ২৫ শতাংশ।