ছবি: শাটারস্টক
শ্বাসতন্ত্রের অসুখে সময়ে কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্রের সরবরাহ নিয়ে বাড়ছে উদ্বেগ! বঙ্গে প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যা চার হাজারের ঘরে আটকে রয়েছে। গত দু’মাস ধরে চব্বিশ ঘণ্টায় মৃত্যুর সংখ্যা ধারাবাহিক ভাবে ‘বালাই ষাট’ হয়ে রয়েছে। তবুও সিসিইউ-আইসিইউ বেডের টানাপড়েন থেকে এখনও পর্যন্ত পুরোপুরি বেরোতে পারেনি সরকারি-বেসরকারি স্বাস্থ্যক্ষেত্র। এই পরিস্থিতিতে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পূর্বাভাস অনুযায়ী নভেম্বরে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি হলে কী হবে তা নিয়ে চিন্তিত বেসরকারি স্বাস্থ্যকর্তাদের একাংশ। কারণ, চাহিদা মতো ভেন্টিলেটর সরবরাহ করতে পারছে না কৃত্রিম যন্ত্র প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলি।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, পুজো পরিক্রমার হাত ধরে আগামী দু’সপ্তাহের মধ্যে রাজ্যে প্রতিদিনের আক্রান্তের সংখ্যায় বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। বেসরকারি স্বাস্থ্যকর্তাদের একাংশের বক্তব্য, রাজ্যের প্রায় ৩৭ হাজার অ্যাক্টিভ রোগীদের মধ্যে প্রায় আশি শতাংশ রোগী ‘হোম আইসোলেশনে’ রয়েছেন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ১৮.৪৫ শতাংশ রোগী। তাতেও মৃত্যুহার নিয়ে উদ্বেগ কমছে না স্বাস্থ্য ভবনের। যার পরিপ্রেক্ষিতে ‘হোম আইসোলেশনে’ থাকা রোগীদের চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে রাখার পাশাপাশি যে সকল হাসপাতালে রোগী মৃত্যুর আধিক্য বেশি তাদের ডেকে পাঠিয়ে কৈফিয়ত তলব করছে স্বাস্থ্য দফতরের কর্তাব্যক্তিরা। স্বাস্থ্য ভবন সূত্রের খবর, সম্প্রতি হাওড়ার একটি সরকার অধিগৃহীত কোভিড হাসপাতালে একই দিনে দশ জন রোগীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। যার প্রেক্ষিতে ওই হাসপাতালের কর্তাকে ডেকে পাঠানো হয়েছিল। সরকারি কর্তাদের বক্তব্য, পরিকাঠামোগত ত্রুটির কারণে এ ধরনের ঘটনা। অন্য দিকে হাসপাতালের কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, সঙ্কটজনক যে সকল কোভিড আক্রান্ত রোগীকে অন্য হাসপাতাল নিতে চাইছে না, তাঁদের সেখানে পাঠানো হচ্ছে। ফলে ওই হাসপাতালে মৃত্যুর ঘটনাও বেশি।
রেফার জনিত সমস্যার কারণ ব্যাখ্যা করে পিয়ারলেসের সিইও সুদীপ্ত মিত্র জানান, এখন হয় রোগী গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে আসছেন নইলে ভর্তির কয়েকদিনের মধ্যে শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে। এ ধরনের রোগীর চিকিৎসায় যে কোনও সময় ভেন্টিলেটরের প্রয়োজন হতে পারে। কিন্তু ভেন্টিলেটর বেড না থাকলে রোগীকে ফিরিয়ে দেওয়া ছাড়া উপায় থাকছে না।
আরও পড়ুন: নিভৃতবাসের রোগীর জন্য নির্দিষ্ট বিধি
আইসিইউ-সিসিইউ শয্যার যে টান রয়েছে তা স্বীকার করে পূর্বাঞ্চলের বেসরকারি হাসপাতালগুলির সংগঠনের সভাপতি তথা আমরি গ্রুপের সিইও রূপক বড়ুয়া জানান, মাসখানেক আগে চারটে ভেন্টিলেটর অর্ডার করেও তাঁরা এখনও তা পাননি। রূপকবাবুর কথায়, ‘‘ভেন্টিলেটর পাওয়া যাচ্ছে না বলে আমরা এইচডিইউ বেড বাড়ানোর উপরে জোর দিয়েছি।’’ ফর্টিসের মেডিক্যাল সুপার চিকিৎসক আরাফত ফয়জল জানান, গত বছর ডিসেম্বরে তাঁদের ১৫টি ভেন্টিলেটর কেনা ছিল বলে কোনও সমস্যা হয়নি। কিন্তু এখন ভেন্টিলেটর, হাই-ফ্লো নেজ়াল অক্সিজেন চাহিদা মতো জোগান দিতে পারছে না সরবরাহকারী সংস্থাগুলি।
ভেন্টিলেটর প্রস্তুতকারী এক বহুজাতিক সংস্থা পূর্বাঞ্চলীয় কর্তা জানান, সারা বিশ্বেই ভেন্টিলেটরের চাহিদা রয়েছে। আগে দু’বছরে দেড় হাজার ভেন্টিলেটর সরবরাহের বরাত পাওয়া যেত। এখন দু’মাসে সেই পরিমাণ যন্ত্র সরবরাহের বরাত রয়েছে। চাহিদা মতো উৎপাদনের পরিমাণ বাড়েনি। ফলে জোগানে খানিক সমস্যা রয়েছে। পাশাপাশি, ইউরোপে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের সূচনাও জোগানে ঘাটতির আরেকটি কারণ বলে মনে করেন তিনি। ওই কর্তার কথায়, ‘‘এখনই কেউ ভেন্টিলেটর চাইলে দিতে পারব না। তবে ছয় থেকে আট সপ্তাহের মধ্যে যন্ত্র সরবরাহ করা সম্ভব।’’
আরও পড়ুন: এক দিনে সুস্থ ৪ হাজারেরও বেশি, এখনও পর্যন্ত সর্বাধিক, দৈনিক সংক্রমণ সামান্য কমল
আর একটি বহুজাতিক সংস্থার পূর্বাঞ্চলের কনসালট্যান্ট জানান, একসময় এ দেশে তৈরি ভেন্টিলেটরের উপরে অনেকে আস্থা রেখেছিলেন। কিন্তু সেই সকল যন্ত্রের বেশিরভাগের গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। একই কথা জানিয়েছেন রূপকবাবুও।
এই পরিস্থিতিতে বিকল্প খোঁজা জরুরি বলে মনে করেন মেডিকার ভাইসচেয়ারম্যান তথা কার্ডিয়োথোরাসিক সার্জন কুণাল সরকার। বস্তুত, এ দিন সকালে এ নিয়ে একটি টুইটও করেছেন তিনি। প্রবীণ চিকিৎসকের বক্তব্য, সরকারি পরিকাঠামোয় ১০৯০ ভেন্টিলেটর রয়েছে। তার মধ্যে সবক’টি ব্যবহার হচ্ছে তা নয়। কুণালবাবুর কথায়, ‘‘এ রাজ্যে সংক্রমণ বৃদ্ধির যে আশঙ্কা করা হচ্ছে, তা সত্যি হলে ভেন্টিলেটর-যুক্ত বেডের চাহিদা বাড়বে। সংস্থাগুলির মুখাপেক্ষী না-থেকে এখন থেকে বিকল্প ব্যবস্থার কথা ভাবতে হবে। সরকারি স্তরে অব্যবহৃত ভেন্টিলেটর কী ভাবে বেসরকারি স্বাস্থ্যক্ষেত্রে কাজে লাগানো যায়, তার যুক্তিসম্মত রূপরেখা তৈরি হওয়া উচিত।’’ রাজ্যে বেসরকারি হাসপাতালগুলির ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থা স্বাস্থ্য কমিশনের চেয়ারম্যান অসীম বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘‘এ ধরনের সঙ্কটের কথা লিখিত ভাবে কেউ জানাননি। তাই মন্তব্য করা সম্ভব নয়।’’