প্রতীকী ছবি।
কোভিড পজ়িটিভ ৭৫ বছরের বৃদ্ধের দেহে অক্সিজেনের মাত্রা কমছে দেখে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দিয়েছিলেন স্থানীয় চিকিৎসক। বুধবার রাত থেকে স্বাস্থ্য দফতরের হেল্পলাইন নম্বর, পুরপ্রতিনিধির সঙ্গে যোগাযোগ করেন বৃদ্ধের ছেলে। ১৮ ঘণ্টা পর বৃহস্পতিবার দুপুরে ভাটপাড়ায় বৃদ্ধের বাড়ির সামনে জেলা স্বাস্থ্য দফতরের অ্যাম্বুল্যান্স যখন পৌঁছল, তখন সব শেষ। মৃত সত্যকিঙ্কর নাগের ছেলে সুজিত নাগের অভিযোগ, হাসপাতালে শয্যার অভাবে বাড়িতেই বাবার মৃত্যু হল।
শনিবার থেকে জ্বরে ভুগছিলেন আগরপাড়া জুটমিলের অবসরপ্রাপ্ত কর্মী সত্যকিঙ্কর। এক দিন পরে তাঁর স্ত্রী অঞ্জলি নাগেরও জ্বর আসে। সোমবার বেলঘরিয়ার জেনিথ হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে দু’জনকে ভর্তি করিয়ে নমুনা পরীক্ষা করানো হয়। সুজিত জানান, বুধবার বাবা-মা দু’জনেরই রিপোর্ট পজ়িটিভ এসেছিল। সন্ধ্যায় সত্যকিঙ্করবাবুর শ্বাসকষ্ট শুরু হলে তাঁকে স্থানীয় চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। ছেলের কথায়, ‘‘বাবার দেহে অক্সিজেনের মাত্রা ৮০ হয়ে গিয়েছিল বলে ডাক্তারবাবু বললেন, দ্রুত হাসপাতালে ভর্তির করাতে হবে।’’
এর পর ভাটপাড়া তৃণমূল কাউন্সিলর মদনমোহন ঘোষের মাধ্যমে পুরসভার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয় বলে দাবি করেছেন সুজিত। পাশাপাশি, স্বাস্থ্য দফতরের ‘১০৭৫’ হেল্পলাইন নম্বরেও ফোন করেন পরিজন। সুজিতের দাবি, ‘‘কেউ ফোন ধরেনি।’’ বৃদ্ধের ছোট মেয়ে অপর্ণা সরকার জানান, অ্যাম্বুল্যান্স বা গাড়ি জোগাড় করে কলকাতার হাসপাতালে যাওয়ার কথাও ভেবেছিলেন। কিন্তু কোভিড রোগীকে নিয়ে যেতে কোনও চালক রাজি হননি। শেষ পর্যন্ত সিলিন্ডার এনে বাড়িতে অক্সিজেন দেওয়ার ব্যবস্থা করেন ছেলেমেয়েরা।
আরও পড়ুন: পুজোয় বঙ্গে করোনা রোগীর সংখ্যা ১.৬৮ লাখেরও বেশি? আশঙ্কায় আইআইএসসি
সুজিত জানান, সকাল ন’টা নাগাদ তাঁরা দেখেন, সত্যকিঙ্করবাবুর দেহে অক্সিজেনের মাত্রা কমে ৫১ হয়ে গিয়েছে। ছেলের কথায়, ‘‘কল্যাণীর একটা নার্সিংহোমে বেড ছিল। আমরা অন্য জেলার বাসিন্দা হওয়ার জন্য ভর্তি হবে না বলল। সাগর দত্ত, এম আর বাঙুরে যোগাযোগ করেছিলাম। কেউ বেড দিতে পারল না।’’
এ দিন বেলায় মানবাধিকার কর্মী দেবাশিস পালের সঙ্গে যোগাযোগ করেন রোগীর পরিজন। কিছু দিন আগে তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। সেই সুবাদে স্বাস্থ্য দফতরের এক আধিকারিকের মাধ্যমে উত্তর ২৪ পরগনার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক তাপস রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেন দেবাশিস। এর পর ডেপুটি সিএমওএইচ (২) সুপর্ণা চট্টোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে বারাসতের জিএনআরসি হাসপাতালে স্বামী-স্ত্রীর ভর্তির ব্যবস্থা করা হয়।
আরও পড়ুন: ‘সংক্রমণ রোখার নিয়মগুলো তো এক, শিখুক কলকাতা’
দুপুর আড়াইটে নাগাদ অ্যাম্বুল্যান্স পৌঁছলে তাতে ওঠার আগে শৌচালয়ে যান বৃদ্ধ। সেখান থেকে ফেরার সময় মাটিতে পড়ে যান। মৃতের মেয়ে জানান, ওই অবস্থাতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। সুজিত বলেন, ‘‘শেষ যখন দেখেছিলাম, তখন বাবার দেহে অক্সিজেনের মাত্রা ৩৫ হয়ে গিয়েছিল! অসহায় অবস্থায় বাবার মৃত্যু দেখে গাড়িতে উঠল মা।’’
পিতৃহারা অর্পিতার অভিযোগ, ‘‘বাবা মাটিতে পড়ে গেলে সাহায্য করার জন্য মা অ্যাম্বুল্যান্সের চালকদের ডেকেছিলেন। ওঁরা বললেন, রোগীকে তাঁরা তুলবেন না। চোখের সামনে বাবার চলে যাওয়াটা মেনে নিতে পারছি না। এর একটা বিহিত হওয়া দরকার।’’ দেবাশিসবাবুর বক্তব্য, ‘‘জেলা স্বাস্থ্য দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ করে স্বামীকে বাঁচাতে না পারলেও স্ত্রীকে অন্তত ভর্তি করা গিয়েছে। যাঁদের সেই সুযোগ নেই, তাঁদের অসহায়তা ভাবুন। রাত থেকে কেউ কিছু করল না!’’
কাউন্সিলর মদনমোহন ঘোষ জানিয়েছেন, বুধবার রাতে তিনি কিছু জানতেন না। এদিন সকাল সাড়ে সাতটায় মৃতের জামাই তাঁকে বিষয়টি জানানোর পরে পুরসভার তরফে জেলা স্বাস্থ্য দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। সকালে জানার পরেও সাত ঘণ্টার বেশি সময় লাগল অ্যাম্বুল্যান্স পৌঁছতে? কাউন্সিলর বলেন, ‘‘বেড পাওয়া যাচ্ছিল না।’’
পুরসভার প্রশাসকমণ্ডলীর চেয়ারম্যান অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, তিনিও বৃদ্ধের মৃত্যুর পরে সব জেনেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘বেডের সমস্যা আছে, স্বীকার করছি। কিন্তু আগে জানলে যে ভাবে হোক শয্যার ব্যবস্থা করতাম। আমাদের নোডাল অফিসারও করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। তিনি সুস্থ থাকলেও আমার বিশ্বাস, বৃদ্ধকে এ ভাবে মরতে হত না।’’ জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক তাপস রায় বলেন, ‘‘বেলায় সব জানার পরে যা করণীয় করেছি।’’
এ ধরনের পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষ কী করবেন তবে? মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক জানান, সাহায্যের জন্য জেলা এবং রাজ্যের হেল্পলাইন নম্বর রয়েছে। কিন্তু ১০৭৫-এ ফোন করেও তো সাহায্য মেলেনি বলে অভিযোগ। মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক বলেন, ‘‘এ বিষয়ে কিছু বলতে পারব না।’’
স্বাস্থ্য অধিকর্তা অজয় চক্রবর্তী বলেন, ‘‘খুবই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। যে কোনও ভাবে স্বাস্থ্য দফতরের কাছে খবরটা আসা দরকার ছিল। ১০৭৫ ভর্তি সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর নয়। বুলেটিনের শেষ পাতায় যে নম্বরগুলি দেওয়া রয়েছে, সেখানে ফোন করতে হত।’’ রাজ্যের স্বাস্থ্য বুলেটিনের শেষ পাতায় হেল্পলাইন নম্বর হিসাবে যেগুলি দেওয়া রয়েছে তা হল, ১৮০০৩১৩৪৪৪২২২/০৩৩-২৩৪১২৬০০। কন্ট্রোল রুমের দু’টি নম্বর হল, ১০৮৩/১০৮৫।