Nabanna

নবান্নের আমলার দায়িত্বজ্ঞানহীনতাই করোনা-আতঙ্ক বাড়াল কলকাতায়

ব্রিটেন থেকে ফেরা আক্রান্ত তরুণের মা নবান্নে কর্মরত। তিনি মঙ্গলবারও নবান্নে গিয়েছেন। পুরোদমে অফিসও করেছেন।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ মার্চ ২০২০ ১৬:৩৯
Share:

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

খোদ মুখ্যমন্ত্রী বার বার অনুরোধ করছেন, নাগরিকদের দায়িত্বশীল হতে। আর্জি জানাচ্ছেন, নিজে সুস্থ থেকে অন্যকে সুস্থ থাকতে সাহায্য করুন। সরকারের বিভিন্ন স্তর থেকে সচেতনতামূলক প্রচার চালানো হচ্ছে একই উদ্দেশ্যে। সকলে দায়িত্বশীল হয়ে করোনাভাইরাসের মতো মারণ-আক্রমণ ছড়িয়ে পড়া যাতে রোখা যায়। কিন্তু, তার মধ্যেই প্রকাশ্যে এল এ রাজ্যেরই এক শীর্ষ আমলার চরম দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ। ওই আমলার ছেলের শরীরে করোনাভাইরাসের প্রমাণ মিলেছে। তিনিই করোনাভাইরাসে রাজ্যের প্রথম আক্রান্ত। গোটা ঘটনায় ক্ষুব্ধ স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারা। গোটা ঘটনায় ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও।

Advertisement

রাজ্যে প্রথম করোনা আক্রান্ত ওই তরুণের মা নবান্নে কর্মরত। তাঁর ছেলে গত রবিবার লন্ডন থেকে ফিরেছেন। বিমানবন্দর থেকে এমআর বাঙুর— সব জায়গা থেকেই ওই তরুণকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালে যাওয়ার জন্য। কিন্তু ওই তরুণ মঙ্গলবার পর্যন্ত তা করেননি। উল্টে তাঁর মা নবান্নে গিয়েছেন। পুরোদমে অফিসও করেছেন। আর ওই তরুণও ঘুরে বেড়ালেন শহরের বিভিন্ন জায়গায়। আর সেখান থেকেই শুরু হয়েছে নবান্ন-সহ শহরের বিভিন্ন জায়গায় সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা। মা উচ্চপদস্থ আমলা। বাবা পেশায় চিকিৎসক। তরুণ পড়েন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রশ্ন উঠছে, সরকারের এত প্রচার, মুখ্যমন্ত্রী-সহ সরকারের সমস্ত স্তরের এত আবেদন, অনুরোধ, বিবৃতি— তার পরেও ওই আমলা কী ভাবে এই ধরনের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ করলেন? কী ভাবে বিষয়টাকে কোনও গুরুত্ব না দিয়ে তিনি অফিস করলেন? এ ঘটনা নিয়ে বুধবার নবান্নে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘‘পরিবারের এক জন প্রভাবশালী বলে বিদেশ থেকে এসেও পার্কে, শপিং মলে ঘুরে বেড়ালেন— এটা আমি সমর্থন করি না।’’

স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, রবিবার ভোরে লন্ডন থেকে কলকাতায় পৌঁছন অক্সফোর্ডের পড়ুয়া ওই তরুণ। বিমানবন্দর সূত্রে খবর, কলকাতায় নামা ইস্তক ওই তরুণ থার্মাল স্ক্রিনিং এড়ানোর চেষ্টা করেন। বিমানবন্দরে থার্মাল স্ক্রিনিংয়ের দায়িত্বে থাকা এক আধিকারিকের অভিযোগ, ‘‘ওই তরুণ নিজের মায়ের প্রভাব খাটিয়ে থার্মাল স্ক্রিনিং এড়িয়ে যান।” তবে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ সরকারি ভাবে এখনও জানাননি যে, ওই যুবকের থার্মাল স্ক্রিনিং হয়নি। ওই দিনই বিমানবন্দর থেকে তাঁকে বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু অভিযোগ, তিনি তা মানেননি। জানা গিয়েছে, বিমানবন্দর থেকে ওই তরুণ সোজা পঞ্চসায়রে তাঁদের আবাসনে যান।

Advertisement

আরও পড়ুন: ছেলের করোনা, নবান্নে আমলার সহকর্মীদের থাকতে বলা হল বাড়িতে

স্বাস্থ্য ভবনের একটি সূত্র জানাচ্ছে, ঘটনাটি জানার পরেই স্বাস্থ্য দফতরের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয় ওই আমলার সঙ্গে। তার পর সোমবার ওই তরুণকে নিয়ে যাওয়া হয় এমআর বাঙুর হাসপাতালে। সেখানে ডেপুটি সুপারের ঘরে তাঁর শারীরিক পরীক্ষা হয়। প্রাথমিক পরীক্ষার পরেই তাঁকে ফের বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু, সেই পরামর্শ না মেনে ছেলেকে নিয়ে ওই আমলা সোজা চলে যান নবান্নে। ছেলে বসে ছিলেন গাড়িতে। কিছু ক্ষণ পরে তিনি ওই গাড়িতে নবান্ন থেকে বেরিয়ে যান। আমলা কিন্তু গোটা দিনই অফিস করেন। সূত্রের খবর, কলকাতায় ফেরার পর একাধিক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করেছেন ওই তরুণ। গিয়েছেন শপিং মল, রেস্তরাঁতেও। যদিও ওই তরুণের পরিবার স্বাস্থ্য দফতরের কর্তাদের কাছে দাবি করেছেন যে রবিবার ফেরার পর থেকে বাড়িতেই ছিলেন তাঁর ছেলে। এর পর মঙ্গলবার সকালে ওই তরুণ বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালে যান।

এক স্বাস্থ্য কর্তা ব্যখ্যা করেন, প্রথমেই যদি ওই তরুণ বিমানবন্দরের স্বাস্থ্য কর্মীদের কথা শুনে বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালে যেতেন, তা হলে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা অনেক কমে যেত। সে ক্ষেত্রে খুঁজে বার করতে হত ওই বিমানে কারা কারা ওই তরুণের আসনের কাছাকাছি ছিলেন এবং বিমানের কর্মীদের চিহ্নিত করতে হত। সে কাজ খুব শক্ত নয়। কারণ তার নির্দিষ্ট তালিকা রয়েছে। ওই স্বাস্থ্যকর্তার কথায়, ‘‘কিন্তু, পরামর্শ না মেনে তিনি বাড়ির গাড়িতে চলে গেলেন। ফলে প্রথমেই তাঁর সংস্পর্শে এলেন গাড়ির চালক। ওই গাড়ির চালক যদি পরবর্তীতে আক্রান্ত হন তা হলে গত ক’দিনে ওই চালক যাঁদের সংস্পর্শে এসেছেন তাঁদের মধ্যেও সংক্রমণের আশঙ্কা তৈরি হল। ঠিক একই ভাবে ওই তরুণ বাড়ি যাওয়ার পর, বাবা-মা থেকে শুরু করে বাড়ির পরিচারক-পরিচারিকা থেকে শুরু করে আত্মীয় এবং প্রতিবেশী— যাঁদের কাছাকাছি গিয়েছেন, তাঁদের সবার মধ্যে ভাইরাস ছড়ানোর আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। একই ভাবে গুনিতকের মতো, ওই প্রাথমিক সংস্পর্শে থাকা ব্যক্তিরা যাঁদের কাছে গিয়েছেন, তাঁরাও থাকবেন আশঙ্কার তালিকায়।’’

আরও পড়ুন: করোনা আক্রান্ত কলকাতার তরুণ স্থিতিশীল, লালারস গেল নাইসেডে

স্বাস্থ্য কর্তাদের একাংশের অভিযোগ, যখন ওই তরুণ জানতে পারলেন, তাঁর লন্ডনের বন্ধু এবং বান্ধবী যাঁদের সংস্পর্শে তিনি ছিলেন, তাঁদের কয়েক জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত, তখন এটা স্পষ্ট তো যে, তাঁর আক্রান্ত হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। তার পরেও ওই আমলা ছেলেকে হাসপাতালে ভর্তি করালেন না কেন? নিজেও সংক্রামিত হতে পারেন এই আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও নিজেকে গৃহবন্দি না করে চলে গেলেন অফিসে! সঙ্গে নিয়ে গেলেন ছেলেকেও! নবান্নে গিয়ে তিনি দেখা করলেন রাজ্যের এক শীর্ষ আমলার সঙ্গে। তার আগে ওই আমলার আপ্ত সহায়কের ঘরে কাটালেন বেশ খানিকটা সময়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন বেশ কয়েক জন। ঠিক একই রকম ভাবে ওই দিন তিনি আরও কয়েক জনের সঙ্গে দেখা করলেন। তাঁদের বাড়ি শহর এবং শহরতলির বিভিন্ন প্রান্তে। এক স্বাস্থ্য কর্তা বলেন, ‘‘যদি আমরা ওই আমলার শরীরেও করোনাভাইরাসের প্রমাণ পাই, তা হলে তো তিনি যাঁদের কাছে গিয়েছেন তাঁদের সকলের মধ্যে ভাইরাস ছড়ানোর আশঙ্কা তৈরি হল।”

বুধবার দুপুরে এই বিষয়ে দীর্ঘ বৈঠক করেন স্বাস্থ্য কর্তারা। এর পরেই সিদ্ধান্ত হয় যে, প্রাথমিক ভাবে ওই আমলার অফিসের কর্মীদের গৃহ-পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। যে শীর্ষ আমলার সঙ্গে সোমবার দেখা করেছিলেন আক্রান্তের মা, তিনিও এ দিন নবান্নে তাঁর অফিসে যাননি। কিন্তু তাতেও আতঙ্ক পিছু ছাড়ছে না স্বাস্থ্য কর্তা থেকে রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষ আমলাদের।

বুধবার বৈঠক শেষে এক স্বাস্থ্য কর্তা বলেন, ‘‘ওই আমলা সোমবার যাঁদের সঙ্গে দেখা করেছেন নবান্নে তাঁদের অনেকেই আবার ওই দিনই করোনাভাইরাস মোকাবিলা করার জন্য মুখ্যমন্ত্রীর ডাকা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।” ওই বৈঠকে রাজ্য প্রশাসনের সব শীর্ষ কর্তারা সকলেই উপস্থিত ছিলেন। এক আধিকারিক ইঙ্গিত দেন, ‘‘যদি ওই আমলার শরীরে করোনাভাইরাসের প্রমাণ মেলে তা হলে নিয়ম অনুযায়ী গৃহ-পর্যবেক্ষণে থাকতে হবে রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষ স্তরকে।”

অন্য এক আধিকারিক মন্তব্য করেন, ‘‘নজিরবিহীন দায়িত্বজ্ঞানহীনতা। তার জেরে বেনজির ঘটনার মুখোমুখি হতে পারে আমাদের রাজ্য!”

স্বাস্থ্য কর্তাদের একাংশের প্রশ্ন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী সোমবারই মহামারি আইন লাগু করলেন রাজ্যে যাতে করোনাভাইরাস প্রতিরোধের লড়াইতে কেউ অসহযোগিতা করতে না পারেন। ওই আইন কি সকলের জন্য সমান ভাবে প্রযোজ্য নয়? তা না হলে রাজ্যের এক জন উচ্চপদস্থ আমলা কী ভাবে এমনটা করলেন?”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement