ইমিউনোলজিস্ট ইন্দিরা নাথ।
ইমিউনোলজিস্ট ইন্দিরা নাথ।
বলা হয়, কুষ্ঠ গবেষণা ও চিকিৎসায় তিনি প্রতিষ্ঠানের সমতুল্য। ইমিউনোলজি নিয়ে গবেষণা ও চর্চা যখন এ দেশে সবে শুরু হয় তখনই তিনি তাতে যুক্ত হন। প্যাথোলজি, কমিউনিকেবল ডিজ়িজ়ের বিশেষজ্ঞ হিসেবেও পরে তাঁর পরিচিতি গড়ে ওঠে। দিল্লির অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্সেসে বায়োটেকনোলজি বিভাগ তাঁরই হাতে তৈরি। পদ্মশ্রী-সহ দেশ-বিদেশের একাধিক সম্মানে ভূষিত ইমিউনোলজিস্ট ইন্দিরা নাথের সঙ্গে সাম্প্রতিক করোনা পরিস্থিতি নিয়ে কথা বললেন দেবাশিস ঘড়াই।
প্র: কুষ্ঠ নিয়ে এক সময়ে মানুষের অনেক ভীতি ও কুসংস্কার ছিল। কোভিড ১৯-এর ক্ষেত্রেও একই ভীতি কাজ করছে। সময় পাল্টালেও রোগকে দেখার চোখ কি তা হলে পাল্টায়নি?
উ: কোথায় আর পাল্টাল? কুষ্ঠ নিয়ে যখন কাজ শুরু করেছিলাম, তখন কুষ্ঠরোগীরা সমাজে ব্রাত্য ছিলেন। কারও কুষ্ঠ হয়েছে শুনলেই তাঁকে একঘরে করে রাখা হত। এক সময়ে দিল্লিতে যমুনার ধারে কুষ্ঠরোগীদের জন্য আলাদা কলোনিই গড়ে উঠেছিল । দুর্ভাগ্যবশত কোভিড ১৯-এর ক্ষেত্রেও একই জিনিস দেখতে পাচ্ছি। সাধারণ মানুষের কথা না-হয় ছেড়েই দিলাম, এমনকি, যাঁরা এই জরুরি সময়ে লড়ছেন সেই চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীরা করোনায় আক্রান্ত হলেও তাঁদের নানা ভাবে হেনস্থা করা হচ্ছে। ফলে সময়ের পরিবর্তন হলেও মানসিকতা হয়তো একই থেকে গিয়েছে। কুষ্ঠ রোগের মতো করোনা নিয়েও ভুল ধারণার শেষ নেই।
প্র: আপনি এক সময়ে বলেছিলেন, অনেকের কুষ্ঠ হয়। কিন্তু তাঁরা সেটা বুঝতেও পারেন না। এমনিই তা সেরে যায়। কোভিড ১৯-এও তো একই জিনিস দেখছি।
উ: হ্যাঁ। হয়তো আপনার হাতে একটা সাদা দাগ দেখা গেল, তা স্পর্শ করলে কোনও সাড়া পেলেন না। কিন্তু কয়েক দিন পরে সেটা মিলিয়ে গেল। অন্য জনের শরীরেও হয়তো কোথাও সাদা দাগ দেখা গেল, সেটা তুলনায় বেশি দিন থাকল। কিন্তু সেটাও সেরে গেল। মানে কুষ্ঠ হয়েও নিজে থেকেই তা সেরে গেল। খুব কম সংখ্যক মানুষই গুরুতর আক্রান্ত হন। কোভিড ১৯-এও একই জিনিস দেখছি। সংখ্যাগরিষ্ঠ রোগীই উপসর্গহীন। অনেকের আবার অল্প জ্বর, কাশি হয়ে সেরে যাচ্ছে। এখানেও ক্রিটিক্যাল রোগীর সংখ্যা কম। কোভিডের ক্ষেত্রে একটা উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, কোনও দেশে মাত্রাছাড়া সংক্রমণ, আবার কোথাও সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা খুবই কম। এর পিছনে শরীরের প্রতিরোধ শক্তির ভূমিকা রয়েছে নাকি অন্য কোনও ‘ফ্যাক্টর’, তা নিয়ে আরও গবেষণা দরকার।
প্র: একটু অন্য প্রসঙ্গে আসছি। গত বছরই প্রথম ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য নিরাপত্তা সূচক’ (গ্লোবাল হেল্থ সিকিওরিটি ইন্ডেক্স বা জিএইচএস ইন্ডেক্স) প্রকাশিত হয়েছিল, যেখানে স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর ভিত্তিতে দেশগুলির ‘র্যাঙ্কিং’ করা হয়েছিল। যার ‘ইন্টারন্যাশনাল প্যানেল অব এক্সপার্টস’-এর অন্যতম সদস্য ছিলেন আপনি। সূচকে সামগ্রিক ভাবে প্রাপ্ত নম্বর অনুযায়ী র্যাঙ্কিংয়ের প্রথম দু’টি দেশ ছিল আমেরিকা ও ইংল্যান্ড। কিন্তু এখন মনে হয় না সূচকের পুনর্মূল্যায়ন প্রয়োজন?
উ: ইতিমধ্যেই এটা নিয়ে আমাদের মধ্যে প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে। সংক্রমণ প্রতিরোধ (প্রিভেনশন), দ্রুত চিহ্নিত করা (ডিটেকশন), পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিক্রিয়া (রেসপন্স)-সহ মোট ছ’টি বিভাগের ভিত্তিতে বিশ্বের ১৯৫টি দেশের স্বাস্থ্য পরিকাঠামো কেমন, তার র্যাঙ্কিং হয়েছিল। সমস্যা হল, জরুরি পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত নেন রাজনৈতিক নেতৃত্ব। সেখানে কোভিড ১৯ নিয়ন্ত্রণে সিংহভাগ দেশের নেতৃত্বই চূড়ান্ত ব্যর্থ! তাই রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে কী ভাবে গ্রেডেশনের আওতায় আনা যায়, তা নিয়ে ভাবা হচ্ছে। তবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তহীনতার পাশাপাশি এই পরিস্থিতির পিছনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থারও (ডব্লিউএইচও) ভূমিকা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ডব্লিউএইচও দেরিতে নড়ে বসেছে।
প্র: মানে ডব্লিউএইচও-র নীতিতেই গলদ রয়েছে বলছেন?
উ: তা তো রয়েছেই। কারণ, এর আগে সার্স, মার্স, এমনকি, ইনফ্লুয়েঞ্জাও আমাদের শিখিয়েছে এই ধরনের সংক্রমণ ড্রপলেটের মাধ্যমে ছড়ায়। তাই শুরু থেকেই মাস্ক পরা ও দূরত্ব-বিধি বজায় রাখার উপরে গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল। সেটা হয়নি। ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো ডব্লিউএইচও-র কথা শুনলেও পশ্চিমের উন্নত দেশগুলো গুরুত্ব দেয় না। কিন্তু ভারতের অবস্থা বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় ভাল। এখানে অনেক বিজ্ঞানী-গবেষক আছেন। ফলে ডব্লিউএইচও কী বলল, সব সময়ে সেটা অনুসরণ না করে দেশের বিশেষজ্ঞদেরও পরামর্শ নেওয়া উচিত। মার্চে যখন লকডাউন করা হল, তত দিনে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। লকডাউন পর্বেই করোনা পরিস্থিতি সামলানোর জন্য হাসপাতালগুলিকে প্রস্তুত করা দরকার ছিল। তা ঠিক ভাবে করা হয়নি। ফলে সংক্রমণ দ্রুত ছড়িয়েছে।
প্র: এই সংক্রমণের সূত্রেই বলি, জিএইচএস ইন্ডেক্সে কোন কোন দেশ প্রাথমিক পর্বেই কোনও সংক্রমণ চিহ্নিত করতে পারে, তার আলাদা বিভাগ ছিল। ভারতের অবস্থান সেখানে কোথায়?
উ: ভারত ছিল অনেকটাই পরে, ৬৭ নম্বরে। সংক্রমণ চিহ্নিত করায় যে খামতি রয়েছে, তা ‘কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং’ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। সংক্রামক রোগের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। সংক্রমণ দ্রুত চিহ্নিত করে তা নির্দিষ্ট গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ রাখা না গেলে এই পরিস্থিতি ফের হতে পারে।
প্র: অনেকে বলছেন, তাড়াতাড়ি প্রতিষেধক বাজারে এসে যাবে...
উ: প্রতিষেধকের গবেষণায় যে তাড়াহুড়ো দেখছি, তাতে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন আমি। বিজ্ঞানীদের উপরে প্রতিষেধক আবিষ্কারে যেন রাজনৈতিক চাপ তৈরি হচ্ছে! তাই ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল যথাযথ ভাবে হচ্ছে কি না, তা নিয়ে চিন্তা থাকছেই। বলা হচ্ছে, প্রতিষেধকের কার্যকারিতা দেখার জন্য স্বেচ্ছাসেবকদের সংক্রমিত করা হবে। কিন্তু যদি সংক্রমিত হওয়ার পরে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কোনও বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়, তখন কী হবে? আমাদের হাতে এমন কোনও ওষুধ নেই, যা দিয়ে কোভিড ১৯-এর চিকিৎসা সম্ভব। ফলে গবেষণার জন্য স্বেচ্ছায় কেউ সংক্রমিত হতে চাইলেও, তা করা নীতিগত ভাবে ঠিক নয় বলেই মনে করি।
(জরুরি ঘোষণা: কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের জন্য কয়েকটি বিশেষ হেল্পলাইন চালু করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এই হেল্পলাইন নম্বরগুলিতে ফোন করলে অ্যাম্বুল্যান্স বা টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত পরিষেবা নিয়ে সহায়তা মিলবে। পাশাপাশি থাকছে একটি সার্বিক হেল্পলাইন নম্বরও।
• সার্বিক হেল্পলাইন নম্বর: ১৮০০ ৩১৩ ৪৪৪ ২২২
• টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-২৩৫৭৬০০১
• কোভিড-১৯ আক্রান্তদের অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-৪০৯০২৯২৯)