ছবি দেখিয়ে ভাইয়ের খোঁজ টনিক ঘোষের। শনিবার, হাওড়ায়। নিজস্ব চিত্র।
‘‘স্যর, একে কোথাও দেখেছেন?’’— মোবাইলের স্ক্রিনে তরুণের ছবিটা রেল পুলিশের দিকে এগিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করলেন মুর্শিদাবাদের বাসিন্দা টনিক ঘোষ। ছবির তরুণ তাঁর ভাই। চেন্নাইয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। শুক্রবার দুর্ঘটনার পর থেকে ভাইয়ের খোঁজ নেই। অস্ফুটে বললেন, ‘‘শুধু জানতে চাই, বেঁচে আছে তো?’’ অন্য দিকে, রেললাইনে শূন্য দৃষ্টি রেখে বসে ছিলেন এক তরুণী। অপেক্ষায়। কত ক্ষণে এসে নামবেন তাঁর বাবা-মা। উৎকণ্ঠা কাটছেই না! মাইকে তখন ঘোষণা হচ্ছে, ‘বালেশ্বর থেকে হাওড়া স্পেশ্যাল ট্রেন ঢুকছে।’ তরুণীর হাত শক্ত করে ধরে স্বামী বললেন, ‘‘চলো, এগিয়ে দাঁড়াই।’’
বালেশ্বর থেকে দু’টি বিশেষ ট্রেনে চাপিয়ে যাত্রীদের হাওড়ায় ফেরানো হচ্ছে বলে শনিবার সকালেই জানিয়েছিল রেল। সেই মতো সকাল থেকেই হাওড়া ও সাঁতরাগাছি স্টেশন জুড়ে ছিল এমনই উৎকণ্ঠার ছবি। বালেশ্বর থেকে প্রথম ট্রেনটি হাওড়ায় ঢোকে বেলা সাড়ে ১১টায়। কিন্তু কোনও আহত যাত্রীকে সেখানে দেখা যায়নি। উপস্থিত রেলের এসডিজিএম বিনীত গুপ্ত বলেন, ‘‘এই ট্রেনে ২০০ জন যাত্রী ছিলেন বলে খবর। বিভিন্ন জায়গায় ট্রেন থামতে থামতে আসায় হয়তো তাঁরা নেমে গিয়েছেন।’’ ওই ট্রেন এ দিন সাঁতরাগাছিতেও দাঁড়ায়নি। পরে কয়েক জন যাত্রী জানান, বালেশ্বর থেকে ট্রেন ধরে তাঁরা হাওড়ার ১৬ নম্বর প্ল্যাটফর্মে নেমেছেন। এ দিন রাত ন’টা নাগাদ বালেশ্বর থেকে আর একটি ট্রেন পৌঁছয় হাওড়া স্টেশনে।
সকাল থেকেই যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে বদলে গিয়েছিল হাওড়া স্টেশনের আট নম্বর প্ল্যাটফর্ম। গার্ডরেল দিয়ে ঘিরে ফেলা হয় একাংশ। রেল ও জেলা প্রশাসনের তরফে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সেখানে নিয়ে আসা হয়। ১৬ নম্বর প্ল্যাটফর্মে নামা কয়েক জনকে ওই শিবিরে চিকিৎসা করাতে দেখা যায়। সেখানেই মাথায় ব্যান্ডেজ বেঁধে দেওয়া হয় তাঁদের এক জন, সোনু শেখকে। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের নিজেদের মতো করে চলে আসতে বলা হয়েছিল।’’
শুক্রবার শালিমার থেকে করমণ্ডল এক্সপ্রেস নিয়ে রওনা দিয়েছিলেন চালক রঞ্জিতকুমার মণ্ডল। নিয়মানুযায়ী খড়্গপুর পর্যন্ত তিনি ওই ট্রেনের চালক ছিলেন। তার পরে খুরদা ডিভিশনের চালক ও সহকারী চালক, যথাক্রমে জি এন মোহান্তি ও এইচ বেহেরাকে দায়িত্ব হস্তান্তর করেন। এ দিন সকালে খড়্গপুর থেকে শিরোমণি এক্সপ্রেস নিয়ে হাওড়ায় ফিরছিলেন রঞ্জিত। সাঁতরাগাছিতে ট্রেন থামতেই তিনি বললেন, ‘‘করমণ্ডল এক্সপ্রেসে তেমন যান্ত্রিক ত্রুটি ছিল বলে মনে হয়নি। খড়্গপুরে বিশ্রাম নেওয়ার সময়ে তাই খবরটা শুনে অবাক হই।’’
দুপুরে সাঁতরাগাছি স্টেশনের পাঁচ নম্বর প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষা করছিলেন সল্টলেকের মৈনাক বেহেতি ও কোমল বেহেতি। মৈনাক বলেন, ‘‘শ্বশুর-শাশুড়ি বেঙ্গালুরু থেকে যশবন্তপুর এক্সপ্রেসে আসছিলেন। এসি-বি-৩ কোচে ছিলেন।’’ বাবা রতন বিয়ানি ও মা শ্যামা বিয়ানিকে ট্রেন থেকে নামতে দেখে কেঁদে ফেলেন কোমল। অন্য দিকে, বেঙ্গালুরুতে দর্জির কাজ করা, বর্ধমানের খাদিজা শেখের কথায়, ‘‘ভাবতে পারছি না যে, বেঁচে ফিরেছি।’’ বিকট আওয়াজ আর ঝাঁকুনিতে ট্রেন থেমে যাওয়ার পরে কোনও মতে নীচে নেমে পরের কয়েকটি কামরা নেই দেখে চমকে গিয়েছিলেন এসি-বি-৪ কামরার বাসিন্দা দিলীপ নায়েক।
ওই ট্রেনই হাওড়ার আট নম্বর প্ল্যাটফর্মে ঢুকতে স্বাস্থ্য শিবিরে তৎপরতা শুরু হয়। কাউকে ব্যান্ডেজ করিয়ে হাসপাতালে পাঠানো হয়, কাউকে বাড়ি ফেরার বাস ধরানো হয়। বিভিন্ন রুটের বাসের ব্যবস্থা করেছিল আঞ্চলিক পরিবহণ শাখা। ওই ট্রেনে ৬৩৫ জন এসেছেন। তাঁদের মধ্যে রেলের স্বাস্থ্য শিবিরে ৩৬ ও জেলা প্রশাসনের শিবিরে ২৭ জন চিকিৎসা করান। হাওড়া জেলা হাসপাতালে জনা পাঁচেক এবং বি আর সিংহ হাসপাতালে এক জনকে ভর্তির জন্য পাঠানো হয়।
চেন্নাইয়ে ভাইপোকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন হালিশহরের বিকাশ শিকদার। এ দিন হাওড়ায় পৌঁছে জানান, কোনও মতে গাড়ি জোগাড় করে আসেন বালেশ্বর স্টেশনে। রাতে সেখানেই ছিলেন। যশবন্তপুর এক্সপ্রেসে আসা, অসমের হাফিজুল আলি বলেন, ‘‘ট্রেন উল্টে যাওয়ায় কাচ ভেঙে বেরোতে গিয়ে পায়ে চোট লেগেছে। শয়ে শয়ে আহত মানুষ পড়ে আছেন বালেশ্বরে। খাওয়ার টাকাও নেই। কী করে বাড়ি যাব, জানি না।’’ চেয়ার ভেঙে বুকে পড়ায় আহত বর্ধমানের বাসিন্দা, নির্মাণকর্মী বাহাদুর শেখ। কাচ পায়ে ঢুকলেও বালেশ্বরে চিকিৎসা হয়নি। একই অভিযোগ করে আর এক যুবক মতি শেখ বলেন, ‘‘বোমা ফাটার মতো আওয়াজ হয়। ডান হাত গিয়ে লাগে রেলিংয়ে। হাত ভেঙেছে। ভাঙা হাত নিয়েই কাল থেকে ঘুরছি।’’ মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে ঘুরছিলেন বিহারের বাসিন্দা দানি চৌপল। তিনি বললেন, ‘‘ট্রেনে ওঠার সাহস আর হবে বলে মনে হয় না।’’