জেলা পরিষদ ইতিমধ্যেই হাতছাড়া হয়েছে। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর খাসতালুক মুর্শিদাবাদের শেষ গড়, বহরমপুর পুরসভা দখল নিতে এ বার ঝাঁপ দিল তৃণমূল।
মুর্শিদাবাদের গ্রামীণ এলাকায় নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পর, তাদের পরের লক্ষ্য যে অধীরের ‘দুর্গ’ বহরমপুর পুরসভা— দিন কয়েক আগেই তা স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন তৃণমূলের মুর্শিদাবাদ জেলা পর্যবেক্ষক শুভেন্দু অধিকারী।
দিন কয়েক আগে জেলায় এসে হুঁশিয়ারিও দিয়ে গিয়েছিলেন, এ বছরের মধ্যেই ওই জেলা থেকে কংগ্রেসের অস্তিত্ব মুছে দেবেন তিনি। বেঁধে দিয়েছিলেন নির্দিষ্ট সময়সীমাও— পুজোর পরেই বহরমপুর পুরসভা যাবে তৃণূলের দখলে। পুজোর আগেই তা হলে এত মরিয়া হয়ে ওঠা কেন?
মুর্শিদাবাদ জেলা তৃণমূলের এক তাবড় নেতা বলছেন, ‘‘আসলে, জেলা পরিষদটা সহজেই ছিনিয়ে নেওয়ায় বহরমপুরের দখলদারির বিষয়টা আর ফেলে রাখতে চাইছে না দল। সে জন্যই এমন তৎপরতা।’’
দলীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, গত দু’দিনে কংগ্রেসের অন্তত ১৬ জন কাউন্সিলর কলকাতা রওনা হয়েছেন। শুভেন্দু ঘনিষ্ঠ এক নেতার কথায়, ‘‘তাঁদের সবাইকেই কলকাতার বিভিন্ন হোটেলে রাখা হয়েছে। দিদির সঙ্গে কথা বলে সবুজ সঙ্কেত পেলেই তাঁদের দলে নেওয়া হবে।’’ কবে?
দলের অন্দরের খবর, তা আজ বৃহস্পতিবারও হতে পারে। তবে তৃণমূলের এক মন্ত্রীর কথায়, ‘‘সম্ভবত ২৩ তারিখ বহরমপুরের ওই কাউন্সিলরেরা দলে যোগ দেবেন।’’
ইতিমধ্যে রবিবার, শুভেন্দুর সভা রয়েছে বহরমপুরের মোহনের মোড়ে। সেই সভার মূল আয়োজক যে, এক কংগ্রেস কাউন্সিলর, জেলা কংগ্রেসর এক নেতাই তা কবুল করছেন। দলবদলের জন্য পা বাড়িয়ে থাকা ওই কাউন্সিলর, গত মাস খানেক ধরে দলের একটি সভাতেও যোগ দেননি বলে জানা গিয়েছে। উল্টে, তাঁকে ঘন ঘন তৃণমূল ভবনে দেখা যাচ্ছে বলেও জানা গিয়েছে।
তৃণমূলের মুর্শিদাবাদ জেলা সভাপতি মান্নান হোসেন অবশ্য কংগ্রেস কাউন্সিলরদের দলবদলের দিনক্ষণের ব্যাপারে খোলসা করে কিছু বলতে চাননি। তিনি বলেন, ‘‘বহরমপুরের বহু কংগ্রেস কাউন্সিলর রোজই যোগাযোগ করছেন। কেউ আমার সঙ্গে, কেউ বা সরাসরি তৃণমূল ভবনে। ঠিক সময়ে ওঁদের দলীয় পতাকা তুলে দেওয়া হবে।’’
পুরসভা যে উল্টে যাওয়ার মুখে জেলা কংগ্রেসর নেতারাও তা বিলক্ষণ জানেন। তবে, ভেঙেও মচকাচ্ছেন না তাঁদের অনেকেই। বহরমপুরের কংগ্রেস বিধায়ক মনোজ চক্রবর্তী বলেন, ‘‘আরে ভাই, এ সবই রটনা। দলের কোনও কাউন্সিলরই তৃণমূলে যাচ্ছেন না।’’
২৮ ওয়ার্ডের পুরসভার ২৬টিই কংগ্রেসের দখলে। গত কয়েক দিন ধরে তাঁদের অনেককেই অবশ্য বাড়িতে নেই। খোঁজ নিলে বাড়ির লোকের বাঁধা উত্তর— ‘‘বাইরে গিয়েছেন, কবে ফিরবেন জানি না।’’ স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিজ্ঞতাও একইরকম। পুরসভায় না পেয়ে কাউন্সিলরের প্রয়োজনীয় সই জোগাড় করতে তাঁদের বাড়িতে গিয়ে শুনতে হয়েছে, ‘শহরের বাইরে আছেন। কয়েক দিন পরে ফিরবেন।’
হবু দলত্যাগীদের সেই তালিকায় রয়েছেন পুরপ্রধান নীলরতন আঢ্যও। তিনি অবশ্য ফোনে বলছেন, ‘‘এখন বহরমপুরের বাইরে আছি। তবে এটুকু বলতে পারি, আমি দলবদল করলে লুকিয়ে চুরিয়ে নয়, সাংবাদিক বৈঠক করে, সকলকে জানিয়েই দল ছাড়ব।’’
এই প্রবল ভাঙনের মুখেও অন্তত জনা ছয়েক কাউন্সিলর যে পুরনো দলেই রয়ে যাবেন, সে ব্যাপারে নিশ্চিত কংগ্রেসের এক জেলা নেতা বলছেন, ‘‘প্রলোভন কিংবা ক্ষমতাই শেষ কথা নয়, এখনও কেউ কেউ আদর্শ মেনে চলেন।
সংখ্যাটা নিতান্তই কম, তবু অন্তত ছ-সাত জন হুমকি-প্রলোভন এড়িয়ে দলে থেকে যাবেন।’’
বহরমপুর শহর কংগ্রেস সভাপতি অতীশ সিংহের অভিজ্ঞতা, ‘‘দিন কয়েক আগে অধীরদার নির্দেশে বহরমপুরের সব কাউন্সিলরকে ডেকেছিলাম। সেখানে তাঁদের বলেছি, বাম আমলে আমাদের চাপ দিতে আর্থিক অবরোধ করেছিল সরকার। কংগ্রেস পিছিয়ে আসেনি। আপনারা সঙ্গে থাকলে এ বারও আমরা পিছিয়ে আসব না।’’
সে দিনের সভায় অন্তত ১৯ জন কাউন্সিলর এসেছিলেন। তবে তাঁদের অনেকেরই ‘ভাবগতিক’ ভাল ঠেকেনি দলীয় নেতাদের।
অতীশ বলছেন, ‘‘আমরা দেখে নিতে চেয়েছিলাম, দলে অনুগত সৈনিক ক’জন।’’ কী দেখলেন?
অতীশ হাসছেন, ‘‘মুখ দেখে কী আর মন বোঝা যায় সকলের, দিন বদলে গিয়েছে!’’