অতি অল্প সময়ে চোখধাঁধানো সুদের টোপে দেদার টাকা তুলে নিত বিভিন্ন বেআইনি লগ্নি সংস্থা। ধরপাকড়, মামলা-মকদ্দমা শুরু হওয়ার পরে সেই সব সংস্থার রমরমা কিছু বন্ধ হলেও সেই একই ফন্দি যেন ফিরে এসেছে বিটকয়েনের রূপে! রূপকথার টাকার গাছ হয়ে। আজ কিনলে থরে থরে ফল ধরবে কাল! ইন্টারনেট জুড়ে এমনই প্রচার চলে ‘বিটকয়েন’ নিয়ে।
সেই লোভে পা দিয়েই সমীর মলহোত্র নামে কলকাতার এক ব্যবসায়ী ১৫ লক্ষ টাকা খুইয়েছেন বলে অভিযোগ। পুলিশের দ্বারস্থ হয়েছেন তিনি। পুলিশ সূত্রের দাবি, সমীরই প্রথম ব্যক্তি, যিনি এ রাজ্যে প্রথম বিটকয়েনের প্রতারণা নিয়ে পুলিশে অভিযোগ দায়ের করলেন। জানুয়ারিতে একই রকম প্রতারণার অভিযোগ দায়ের হয়েছিল পুণেতে।
বিটকয়েনের মতো ক্রিপ্টোকারেন্সি (অনলাইনে তৈরি হওয়া টাকা, যার কোনও বাস্তব উপস্থিতি থাকে না। কিন্তু সুরক্ষিত ব্লকচেন প্রযুক্তিতে কেনাবেচা চলতে থাকে)-র মাধ্যমে প্রতারণার পাশাপাশি টাকা পাচার বা সন্ত্রাসবাদীদের অর্থ জোগানোর অভিযোগও উঠছে বিস্তর। এ বারের বাজেটে বিটকয়েনের মতো ক্রিপ্টোকারেন্সি নিষিদ্ধ করার কথা জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। তারই মধ্যে সমীরের এই অভিযোগ নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
আরও পড়ুন: গেরুয়া মঞ্চে বিএসএফ ডিজি, বিতর্ক তুঙ্গে
সমীরের অভিযোগটা ঠিক কী?
ওই ব্যবসায়ী জানান, ২০১৬ সালের অগস্টে তাঁর পরিচিত এক সফটওয়্যার ব্যবসায়ীর কাছে তিনি প্রথম বিটকয়েনে টাকা বিনিয়োগের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। ওই ব্যবসায়ী ভিডিও-কল করে এক বিদেশির সঙ্গে সমীরের কথা বলিয়ে দেন। সমীর বলেন, ‘‘জ্যাক নামে ওই বিদেশি নিজেকে আন্তর্জাতিক টাকা পাচার চক্রের সঙ্গে জড়িত বলে দাবি করেছিলেন। বিটকয়েনে বিনিয়োগ করলে চটজলদি দ্বিগুণ-তিন গুণ টাকা মিলবে বলেও আশ্বাস দেন তিনি।’’ তার পরে সমীর কয়েক দফায় তাঁর পরিচিত ব্যবসায়ীকে নগদ ১৫ লক্ষ টাকা দেন। বিনা রসিদেই। সমীর বলেন, ‘‘এ-সব নগদ লেনদেনের তো রসিদ হয় না। তবে এক জন সাক্ষী রয়েছে।’’ ওই টাকা দিয়ে ২২টি বিটকয়েন কেনা হয়েছিল। সমীরের দাবি, বিটকয়েনের ব্যাপারটা তিনি সে-ভাবে জানতেন না। পরে বিটকয়েন বিভিন্ন দেশে নিষিদ্ধ হয়েছে জেনে টাকা ফেরত চান। কিন্তু মেলেনি। তার পরে তিনি গড়িয়াহাট থানা আর লালবাজারে গোয়েন্দা-প্রধানের কাছে অভিযোগ জানান। কিন্তু অভিযুক্ত এখনও ধরা পড়েনি।
সমীরের অভিযোগ নিয়ে তদন্ত চলছে। কিন্তু তিনি ১৫ লক্ষ টাকা নগদে লেনদেন করলেন কেন, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ওই টাকার উৎস কী, আছে সেই প্রশ্নও। পুরো বিষয়টি আয়কর দফতরকেও জানানো হচ্ছে।
সাইবার অপরাধ বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, সমীর যে-ভাবে বিনিয়োগ করেছিলেন, সেই কায়দায় টাকা পাচারের ঘটনা ঘটে। আগে যেটা হাওয়ালার মাধ্যমে হত, এখন সেটা করা হচ্ছে বিটকয়েনে। ইন্ডিয়ান স্কুল অব এথিক্যাল হ্যাকিং-এর অধিকর্তা সন্দীপ সেনগুপ্ত জানান, বিটকয়েন কেনাবেচায় একটি আইডি-পাসওয়ার্ড থাকে। কিন্তু ক্রেতা-বিক্রেতার কোনও ব্যক্তিগত তথ্য থাকে না। তাই তদন্তে নেমে ক্রেতা-বিক্রেতার পরিচয় পাওয়া দুষ্কর। সুরক্ষিত প্রযুক্তির জন্য বিটকয়েন চুরি করাও মুশকিল।
রাজ্যের সাইবার মামলার বিশেষ কৌঁসুলি বিভাস চট্টোপাধ্যায় বলছেন, বিটকয়েনে কোনও সরকারি নিয়ন্ত্রণ নেই। পরিচয় লুকিয়ে কিছু লোক এই টাকা তৈরি করে নেট-দুনিয়ায় ছাড়ছে। তাই কারা এটা তৈরি করছে, কারা কিনছে, টাকা কোথা থেকে কোথায় যাচ্ছে— জানা যায় না। এ বিষয়ে সরকার কী করছে, সেই প্রশ্ন তুলে কলকাতা হাইকোর্টে জনস্বার্থের মামলাও দায়ের করেছেন বিভাসবাবু।