—ফাইল চিত্র।
বছর বছর বেলগাছটার ধিঙ্গিপনা বেড়েই চলছে— গজর গজর করতে থাকেন বামুনবাড়ির গিন্নি। বেজায় হাঁকডাক তাঁর। তল্লাটের একমাত্র আচার্য পরিবার। এই সে দিনও বেলগাছের ডালপালা হাতের নাগালে ছিল। বামুনগিন্নি গজরাতে থাকেন, দিন দিন ড্যাং ড্যাং করে বেড়েই চলেছে গাছটা। এখন আর হাত যায় না। এ দিকে বেলা কত্ত হল! মকবুলটা গেল কোথায়! আজ কী বার সে খেয়াল কি নেই ওর! মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনিবার এই তো মাত্র তিন দিন বেলপাতা লাগবেই লাগবে। সে ব্যাটা তো জানে, বেলপাতা ছাড়া আজ ঠাকুরঘরে পুজোই শুরু হবে না।
বড় রাস্তার ও-পারের বাজার থেকে লোকে ফেরে। বামুনগিন্নি জানতে চান, ‘‘মকবুলকে দেখলে নাকি বাজারে?’’ গলির রাস্তা ধরে ছেলে-ছোকরারা দৌড়ে যায়, বামুনগিন্নিও ছুটতে থাকেন, ‘‘অ্যাই থাম, ও দিকে মকবুলকে দেখলি?’’ মকবুল আয়, কোথায় আছিস, কটা বেলপাতা পেড়ে দিয়ে যা, বামুনবাড়ির পুজো অপেক্ষা করে আছে।
হয়তো মকবুল ফুটো হওয়া চালে বিছানোর জন্য পলিথিন জোগাড় করতে গিয়েছে। হয়তো মকবুল দিনহাজির কাজ খুঁজতে চৌপথীতে দাঁড়িয়েছিল। হয়তো মকবুল বড় নাতনির কথা রাখতে ছবি আঁকা পেন্সিল বাক্স দাম করতে গিয়েছিল। হয়তো মকবুল...। তার পর মকবুল ফিরে আসে, ফিরতে হয় তাকে লম্বা আঁকশি নিয়ে। বেলপাতা পেড়ে দেয়। মকবুলের হাত থেকে বেলপাতা নিয়ে বামুনগিন্নি ব্যস্ত পায়ে পিছন ফেরার আগে আদর মাখা স্বরে বলেন, ‘‘আরও ক’টা পাতা, জোড়া বেল পেড়ে রেখে দিস। ক’টা আমপল্লবও। ষষ্ঠীর পর থেকে তোর ছায়াটাও গ্রামে দেখা যাবে না।’’
পান খাওয়া লাল দাঁত বার করে মকবুল এক গাল হাসে। দুপুরের হাওয়ায় টপাটপ শিউলি ঝরে পড়তে থাকে টেকাটুলির কালীরহাটের ভেঙে চৌচির সরু রাস্তায়, সর পড়া পুকুরের জলে, গ্রামের বুড়ো বেলতলায়। জলপাইগুড়ির কোলাহলহীন এই পাড়াগাঁ জানে, পুজোর ক’দিন বামুনগিন্নির জন্য বেলপাতা, আমপল্লব, দুব্বো এ সব তুলে আনবে না মকবুল। সে যাবে শহরে।
গ্রাম ছুঁয়ে শুয়ে আছে চার লেনের পূর্ব-পশ্চিম মহাসড়ক। রোদে এখন তেজ থাকলেও জ্বালাপোড়া নেই। সকালের ধবধবে সাদা রঙের রোদ দুপুরে এসে হালকা কমলা রঙের হয়ে যাচ্ছে। মকবুল এই রোদ চেনে। নরম হতে থাকা এই রোদ জানিয়ে দেয়, পুজো আসছে। তার অপেক্ষায় আছে বারো মাসের ধুলো জমা এক দুর্গাবেদি। বৃষ্টি পেয়ে মাঠ থেকে তরতরিয়ে উঠে এসেছে লতাপাতা, ঘাসগুলো লম্বা হতে হতে যেন ছোট ছোট গাছ হয়ে গিয়েছে। মকবুল ঝোপ কাটবে, বেদি সাফ করে ধুয়ে দেবে, তার পরে জলে গোবর গুলে এনে ছড়াতে হবে। কংক্রিটের বেদি থেকে একটু দূরে ঘাস তুলে বেড়ার ঘর তৈরি করতে হবে। মকবুলই বেড়া বাঁধবে। তার পরে গোবর জল দিয়ে লেপতে হবে। সেখানে একটি বেলগাছ পুঁততে হবে, সেই গাছও কেটে আনে মকবুল। কাউকে বলে দিতে হয় না, পরপর কী করতে হয়, সব জানে সে।
মকবুল জানে, কবে ঘট বসবে, কতগুলি আমের পল্লব লাগবে। মাঠের কোন দিকে দুব্বো ঘাস হয়, তা-ও জানে। বেশি করে দুব্বো তুলে আনলেও পুজো চলতে চলতে কী ভাবে যেন শেষ হয়ে যায়। মাঝপথে পুজো থামিয়ে, পুরোহিতকে বলতেই হবে, “মকবুল, দুব্বো নিয়ে আয়, তাড়াতাড়ি।” আজ প্রায় ত্রিশ বছর হয়ে গেল, আগে থেকে সব জোগাড় করে রাখলেও ঠাকুরমশাই পুজোয় বসার পরে দুব্বো, আমের পাতা, বেল পাতা, কাঁচা দুধ, আতপ চাল, গোটা ফল, কিছু না কিছু আনতে আবার দৌড়তে হবেই।
এক বার তো বোধন শুরুর পরে নজরে এল, নবপত্রিকা সাজানোর জোড়া বেলের একটি ডাল থেকে খসে গিয়েছে। একটি ডালে দু’টো বেল লাগবেই। পুজো থেমে যাওয়ার জোগাড়। অভয় দিল মকবুল, “পুজো চালিয়ে যান ঠাকুরমশাই, বেল এনে দিচ্ছি।” পাড়ার কার বাড়িতে বেল গাছ আছে, মকবুলের সে সব মুখস্থ। দৌড়ে গিয়ে জোড়া বেল পেড়ে এনে দিল। তার পরে ঢাক বাজল, কাঁসর বাজল, বোধন হল ময়নাগুড়ির দুর্গাবাড়ির সর্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটির পুজোর।
সে সব গল্প জানে পাড়ার লোকেও। গত বছরই তো। মহা অষ্টমীর অঞ্জলি চলছে। এ দিকে ঝুড়িতে ফুল নেই। শুধু পাতা। ফুল না পেয়ে রাগারাগিও শুরু হওয়ার জোগাড়। অঞ্জলি ছেড়ে কে ফুল আনতে যাবে? সেই মকবুল! বাজার থেকে গাঁদা ফুলের কয়েকটা মালা আনল, পাড়ার বাড়ি বাড়ি থেকে নিয়ে এলো টগর, জবা, অতসী, শিউলি, অপরাজিতা। এক ঝুড়ি ফুল এনে নীচ থেকে তুলে দিয়েছিল পুজো বেদিতে। নিজে ওঠেনি। পুজোর আগে বেদিতে ওঠে মকবুল, ধুলো-দাগ পরিষ্কার করতে। বিসর্জনের পরে পচে যাওয়া ফুল, সিঁদুর লাগা পানপাতা, প্রতিমার গায়ের থেকে খসে পড়া রং করা মাটির ঝুরো ধুয়ে ফেলতেও। শুধু পুজোর দিন ক’টা বেদিতে ওঠে না মকবুল। কেউ বারণ করেনি। তবু ওঠে না।
এ ভাবেই ত্রিশ বছর পার হয়ে যায়। সদ্যোজাত মেয়েটা বাঁচল না। বড় মেয়েটা মরে গেল। তার পরে তিন ছেলে হল। কোনও কোনও বছর ছেলেদের অসুখবিসুখও হল। তবু মকবুল পুজোর কাজে যাওয়া বাদ দেয়নি। প্রতি বছর মহালয়ার আগের দিন এসে হাজির হয় দুর্গাবাড়ির মণ্ডপে।
কে বলে দেয় মকবুলকে, এ সব তিথি, পাঁজি?
সুতির মলিন জামা, লুঙ্গি পরে টেকাটুলির এক-দালানের ঘরে প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে মকবুল বলেন, “কে আবার বলে দেবে? আমি তো নিজেই জানি। এত বছর পুজোর কাজ করছি। পুজোর সব নিয়ম জানি। দুর্গা ঠাকুরের কোন মেয়ে বড়, কোন ছেলে ছোট, তা-ও জানি। অসুর যে ছদ্মবেশে আসে, তা-ও জানি।”
টিনের চাল ছাওয়া বাড়ি, একটা বড় ঘরকে ভাগ করে ছেলে, বৌমা, নাতি-নাতনি নিয়ে যৌথ সংসার। উঠোনের এক পাশে ছাপড়া বেড়ার বাড়িতে অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে থাকেন মকবুলের দিদি মহিমা খাতুন। একহারা চেহারা, গায়ের রং রোদে পোড়া। তিনি হাঁক পাড়েন, “ও মজিনা, পান সুপারি আন।” মকবুলের স্ত্রী মজিনা। দেশি পানপাতার নীচ থেকে উঁকি দেয় স্টিলের থালার নকশা, নকশার খাঁজে খাঁজে মরচের দাগ।
মকবুল লাজুক, মুখে কথা কম। দিদি মহিমার বুক ভরা কথা। বলতে থাকেন, “আমরা এই গ্রামে কয়েক ঘর মুসলমান। আগে আরও অনেক পরিবার ছিল। অনেক বছর আগে বাকিরা এই গ্রাম থেকে উঠে গেল। শুনেছি, তখন আমাদের বাবা-চাচাদের ওই বামুনবাড়ির, দাসবাড়ির ঠাকুরদাদারা যেতে দেননি।” মকবুল বসে বসে দিদির মুখে পুরনো গল্প শুনতে থাকেন। পাশে দাঁড়িয়ে প্রথম শ্রেণিতে পড়া আরনিয়া, চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া অনু, সদ্য স্কুলে ঢোকা সানিয়ারা দাদির বলা গল্প শুনতে থাকে।
মহিমার মনের ঝাঁপি থেকে বেরিয়ে পরা গল্পগুলোও ছুটতে থাকে। মহিমা বলতে থাকেন, “আমাকে বাড়িতে শৈমা বলে ডাকত। গায়ের রং কালো বলে ওই দাস বাড়ির ঠাকুমা আমাকে বলত, তোকে আমি শৈমা ডাকব না, শ্যামা ডাকব। তাই ডাকত। সেটা শুনে সকলে খুব মজা পেত। দাস বাড়িতে কালীপুজো এখনও হয়। আমাকে পাশে বসিয়ে ঠাকুমা পুজোর জোগাড় করত। এখনও ওই বাড়িতে পুজোর আগে আমার ডাক পড়ে। পেতলের প্রদীপ, কালী ঠাকুরকে ভোগ দেওয়ার বাসনপত্র আমি ধুয়ে দিই।” গল্প চলতে থাকে, বেলা বাড়তে থাকে, বাড়ির পাশে মহাসড়ক দিয়ে অর্নগল গাড়ি ছুটতে থাকে উত্তরপ্রদেশ, অসম, মণিপুরে।
মহিমা বলতেই থাকেন, “সত্যি বলতে কী, আমরা কিন্তু ইদের আগে জামাকাপড় কিনি না। পুজোর সময়ে বাচ্চাদের জামাকাপড় কিনে দিই। ওরা সেই জামা পরে মণ্ডপে যায়। ভাই যে পুজোয় কাজ করে, এক দিন সবাই মিলে সেই পুজো দেখতে যাই। ওরা আমাদের যত্ন করে খিচুড়ি খেতে দেয়। ভাই তো পুজোর দিনে নিরামিষ খায়।” কেউ বলেনি। তবু মকবুল ষষ্ঠী থেকে নিরামিষ খান।
গল্পে গল্পে রোদের রং ফিকে হয়। উঠোনে ছায়া আরও লম্বা হয়। বামুনগিন্নি শান্তা আচার্য মজিনাকে ডাকতে আসেন। পুজোর বাসন ধোয়া থেকে মেলা কাজ জমে আছে বাড়িতে। গল্প ফেলে মজিনা রওনা দেন আচার্য বাড়ির দিকে। গল্প ফেলে মকবুলও ঘরে গিয়ে জামা বদলে আসেন। হাতে আসন। শুক্রবারের নমাজে বসবেন। কোনও শুক্রবারই মসজিদে যাওয়া বাদ দেন না তিনি। দুর্গাপুজোয় ষষ্ঠী থেকে দশমীর মাঝে শুক্রবার পড়লে তখন কী করেন? মকবুল হাসেন। “কত বারই তো পড়েছে।”
কাঁধে কাপড়ের আসন ফেলে, সাইকেলের প্যাডলে পা রেখে মকবুল বলেন, “এ বছরও তো ষষ্ঠী শুক্রবারে। পুজোর কাজ ফেলে মসজিদে যাওয়া হবে না। কোনও বারই যাইনি। বছরে একটা দিনের ব্যপার তো। ঠাকুর বা আল্লা ওতে কেউ কিছু মনে করবেন না।”
সাইকেল নিয়ে মকবুল হোসেন মসজিদের পথে এগিয়ে যান। বাকি গল্প পড়ে থাকে রাস্তায়, টুকটাক উড়ে উড়ে যায় আশ্বিনের বাতাসে।