প্রতীকী ছবি
ওঁরাও সংখ্যালঘু।
সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন ওঁদের রক্ষাকবচ দিয়েছে। শরণার্থী হিসেবে প্রতিবেশী তিন মুসলিম দেশ থেকে এ দেশে এলেও পাঁচ বছর বাদে ওঁরা নাগরিকত্ব চেয়ে আবেদন করতে পারবেন। মুসলিমদের মতো ওঁদের কেউ ‘অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে দেগে দেবে না। কিন্তু তা-ও পুরোপুরি স্বস্তিতে নেই নদিয়ার খ্রিস্টানেরা।
এ রাজ্যের খ্রিস্টানদের একটা বড় অংশের বাস নদিয়া জেলায়। সামনে বড়দিন। কিন্তু রাজ্য তথা দেশের নানা প্রান্ত যখন এই নতুন আইন নিয়ে অশান্ত, ওঁরাও খুশিতে গা ভাসাতে পারছেন না। অবরোধ-আন্দোলনের জেরে বড়দিনের প্রস্তুতিও অনেকটাই থমকে আছে। তবে সবচেয়ে বড় কথা, ভারতের মতো ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ দেশে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগাভাগি তাঁদেরও অনেককে ধাক্কা দিয়েছে।
কেউ-কেউ ভাবছেন, ভবিষ্যতে যে আবার আইন সংশোধন করে তাঁদেরও বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া হবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? সংখ্যালঘু প্রতিবেশীর ঘর পুড়লে আমার ঘরও কি নিরাপদ? ওড়িশার কেওনঝড়ে উগ্র হিন্দুত্ববাদী বজরং দল যে ঘরে আগুন লাগিয়ে খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারক গ্রাহাম স্টুয়ার্ট স্টেইনস এবং তাঁর দুই নাবালক পুত্রকে পুড়িয়ে মেরেছিল, তা-ও মনে পড়ে যাচ্ছে কারও-কারও।
কৃষ্ণনগরের স্কুলশিক্ষক অরুণাংশু জেমস বিশ্বাস বলছেন, ‘‘ভারতীয় সংবিধানের সবচেয়ে গর্বের বিষয় হল সাম্য, মৈত্রী ও ধর্মনিরপেক্ষতা। তাই ধর্মের ভিত্তিতে বৈষম্যমূলক আচরণ না করে সবাইকে ভারতীয় হিসাবে যদি সমান নজরে দেখা হয়, তা হলেই সংবিধানের আদর্শ অক্ষুণ্ণ থাকবে।’’ তাঁর মতে, ‘‘এমন আইনের প্রতিবাদ অবশ্যই হওয়া উচিত, তবে শান্তিপূর্ণ উপায়ে। প্রতিবাদের নামে হিংসার আশ্রয় নিয়ে, ট্রেন-বাস পুড়িয়ে, রাস্তা আটকে প্রতিবাদ কখনওই সমর্থন করা যায় না।’’
কৃষ্ণনগর রোমান ক্যাথলিক চার্চের কাছেই আর সি পাড়া বড়দিন উৎসব কমিটি আসন্ন বড়দিন উপলক্ষে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। ওই পাড়ায় হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান তিন সম্প্রদায়ের মানুষেরই বাস। সকলেই বড়দিনের উৎসবে শামিল হয়। উৎসব কমিটির সম্পাদক ডমিনিক প্রতিম মণ্ডল বলেন, ‘‘আমরা সবাই মিলে-মিশে বাস করি। আলাদা করে ধর্মের ভিত্তিতে কোনও আইন সমর্থনযোগ্য নয়। একটা ধর্মনিরপেক্ষ দেশে কোনও আইন যদি নানা ধর্মের মানুষের মধ্যে বিভাজনের বাতাবরণ তৈরি করে, সেটা কাম্য নয়।’’
তবে জাতীয় নাগরিক পঞ্জি নিয়ে খ্রিস্টানদের অহেতুক ভয়ের বা চিন্তার কারণ দেখছেন না রিজিওনাল লেইটি কমিশনের রাজ্য সম্পাদক সমীর স্টিফেন লাহিড়ী। তিনি বলেন, ‘‘পাকিস্তান বা আফগানিস্তান থেকে কোনও খ্রিস্টান পরিবার পশ্চিমবঙ্গে এসে বাস করছেন, এমন কোনও খবর আমাদের কাছে নেই। এ রাজ্যের স্থানীয় মানুষই বিভিন্ন সময়ে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছেন।’’
সমীর স্টিফেন জানান, ১৯৪৭ সালের আগে অবিভক্ত ভারতে পূর্ববঙ্গ (অধুনা বাংলাদেশ) থেকে কিছু খ্রিস্টান পরিবার এ দিকে এসেছিল বলে জানা যায়। সেই সব পরিবারের সদস্যেরা অনেকে রানাঘাট, হবিবপুর এবং কলকাতার তালতলা অঞ্চলে ছড়িয়ে আছেন। তিনি বলেন, ‘‘প্রতিটি খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী মানুষের জন্ম, বিবাহ, মৃত্যুর নথিও গির্জায় রাখা আছে। স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশ থেকে কোনও খ্রিস্টান পরিবারের ভারতে এসে বসবাসের খবর জানা নেই। তবে কোনও আইনে যাতে ধর্মের ভিত্তিতে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি না হয়, সেটা ধর্মনিরপেক্ষ দেশের সরকারের অবশ্যই দেখা উচিত।’’ বড়দিনের মুখে অশান্তির আবহ ছায়া ফেলেছে বড়দিনের প্রস্তুতিতেও। এই সময়ে দেশের নানা প্রান্তে কাজে যাওয়া খ্রিস্টানেরা ছুটি নিয়ে বাড়ি আসার চেষ্টা করেন। কিন্তু রাস্তাঘাট, রেলে অচলাবস্থার দরুন অনেকেই বাড়ি ফিরতে পারেননি। কৃষ্ণনগরের জোসেফ পীযূষ বিশ্বাসের মেয়ে মৌসুমী মণ্ডলের বেঙ্গালুরু থেকে ফেরার কথা। তিনিও আটকে আছেন। মেয়ে কবে কী ভাবে নিরাপদে আসবে, আপাতত সেটাই পীযূষের বড় চিন্তা।
অনেকে আবার বড়দিনের বাজার করতে কলকাতা যেতে পারছেন না। অচলাবস্থার দরুন জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যেতে পারে বলেও চিন্তিত হয়ে পড়েছেন কেউ-কেউ। সবাই চাইছেন, দ্রুত শান্তি ফিরুক। কৃষ্ণনগর রোমান ক্যাথলিক চার্চের ভারপ্রাপ্ত ফাদার রেভারেন্ড অংশু গাইন জানান, তাঁর গির্জা সাজাবেন যে শ্রমিকেরা, তাঁরা সকলে নিয়মিত কাজে আসতে পারছেন না। তার ফলে বড়দিনের প্রস্তুতিতে কিছুটা তো বিঘ্ন ঘটছেই। তবে তার পরেও ফাদার রেভারেন্ড বলছেন, ‘‘ধর্ম যেন কখনও মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ তৈরি না করে, তা দেখা জরুরি। সব ধর্মের মানুষ এক সঙ্গে শান্তিতে থাকুন, দয়াময় ঈশ্বরের কাছে সেটাই আমাদের প্রার্থনা।’’