ভাঙা রাস্তা দিয়ে বালি তুলতে চলেছে ট্র্যাক্টর। মহানন্দা নদীর পারে, চোপড়ার দোলুয়া এলাকায়। —নিজস্ব চিত্র।
‘‘কথায় কথায় গুলি চলে। বোমাবাজি হয়।’’
‘‘চোপড়া যেন দুষ্কৃতীদের মুক্তাঞ্চল।’’
৩১ নম্বর জাতীয় সড়ক ইসলামপুর থেকে শিলিগুড়ির দিকে গিয়েছে। সেই রাস্তা থেকেই ঢুকতে হবে চোপড়ার পথে। যে পথের একটি অংশ চোপড়া বাজারে গিয়েছে, গিয়েছে বিধায়ক হামিদুল রহমানের বাড়িতে, অন্য একটি অংশ গিয়েছে দাসপাড়া বা সোনাপুর।
এই পথ ধরে এগোতে এগোতে শোনা যাবে উপরের কথাগুলি। কেউ নিজের নাম বলতে চান না। জিজ্ঞেস করলে হয় সরাসরি জানিয়ে দেন, “আমি নাম বলব না।” নয়তো মুখ ঘুরিয়ে নেন। কেন? তাঁদের কথায়, কাদের কাছেই বা যাবেন এই অভিযোগ নিয়ে!
মনোনয়ন-পর্বের মধ্যে সেই চোপড়া-ই আরও একবার উত্তপ্ত হল। মার খেলেন বাম-কংগ্রেসের লোকজন। মাথায় গুলি নিয়ে আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন তাঁদেরই এক সহযোগী। এই ‘সন্ত্রাসের’ ফল? পরিসংখ্যানে দেখা গেল, চোপড়ার ওই অংশে বিরোধীরা কার্যত কোথাও মনোনয়ন দিতে পারেননি।
চোপড়ায় অনেক দিন ধরেই নিজের রাজপাট গুছিয়ে চালাচ্ছেন হামিদুল। যিনি ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটেও তৃণমূলকে ৪৪,৭৭৭ ভোটের ‘লিড’ দিয়েছিলেন। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে নিজে জেতেন ৬৪,৯০৫ ভোটের ব্যবধানে। যদিও তাঁর দাবি, মানুষ উন্নয়নের পক্ষে ভোট দিয়েছে।
কিন্তু সত্যিই কি তাই?
ভহিসপিটা হয়ে সোনাপুর যাওয়ার রাস্তায় পড়ে প্রেম চাঁদগছ গ্রাম। সেখানকার এক বড় চা বাগানে ঢুকলেই দেখা যায়, রাস্তার পাশে নতুন হয়েছে আদিবাসী গ্রাম। সে গ্রামের উৎপত্তির কারণ জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আদিবাসী চা শ্রমিকেরা জানান, এলাকার ওই বাগান কিছু লোক বেচে দেওয়ার ‘ছক কষেছিল’। তা রুখতেই তাঁরা নতুন গ্রাম গড়েছেন। মাঝিয়ালি এলাকার এক ক্ষুদ্র চা চাষির ক্ষোভ, ‘‘চা বাগানের জমি দখল নিয়ে অভিযোগ জানাব কাকে? এলাকায় ব্যবসা করে খেতে হবে আমাদের।’’
উত্তর দিনাজপুর চা-বাগিচা শ্রমিক সংগঠনের জেলা সম্পাদক তথা সিটুর সম্পাদক স্বপন গুহনিয়োগীর। তাঁর অভিযোগ, ‘‘চোপড়ার বড়-বড় চা বাগানগুলি দুষ্কৃতীরা তৃণমূল নেতাদের মদতে কম দামে কিনে প্লট করে বিক্রি করছে। সম্প্রতি ভহিসপিটার একটি চা বাগানে এমন চেষ্টা হলে, কিছু লোকজন বাধা দিয়েছেন।’’ সম্প্রতি মনোনয়নের মিছিলে আক্রান্ত হয়েছিলেন কংগ্রেসের ব্লক সভাপতি অশোক রায়। তিনি বলেন, ‘‘বন্ধ হয়ে যাওয়া চা বাগানে ছায়া দেওয়ার গাছ পর্যন্ত কেটে নিয়ে চলে যাচ্ছে দুষ্কৃতীরা। এলাকার তৃণমূল নেতাদের মদত ছাড়া তা কি সম্ভব!’’
চোপড়ার সোনাপুর এলাকায় সংকীর্ণ রাস্তা নেমেছে মহানন্দায়। প্রতিদিন বালি বোঝাই ডাম্পারের লাইন থাকে সেখানে। রাস্তার বেহাল পরিস্থিতি চোপড়ার ঢোকার আগে, দোলুয়া স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কাছে। এর জন্য বালির অবৈধ কারবারে ব্যবহৃত গাড়ির অবাধ চলাচলের দিকে আঙুল তুলেছেন এলাকাবাসী। বিজেপির উত্তর দিনাজপুর জেলার সহ-সভাপতি সুরজিৎ সেন বলেন, ‘‘চোপড়ার দুষ্কৃতীরা তৃণমূলের নেতাদের মদতেই এলাকার চা বাগানের জমি দখল, বালির অবৈধ ব্যবসার মতো কারবার ফেঁদে বসেছে। কর্তৃত্ব বজায় রাখতে এলাকায় রয়েছে দুষ্কৃতীদের যাতায়াত। তাই এত গন্ডগোল।’’
বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া চোপড়া থেকে নেপালও খুব দূরে নয়। আবার উত্তর দিনাজপুরের বিস্তীর্ণ অংশের সঙ্গে সীমানা রয়েছে বিহারের। পুলিশ সূত্রের দাবি, ভৌগোলিক এই অবস্থানের কারণেই দুষ্কৃতীরা এক এলাকায় ঝামেলা পাকিয়ে, অন্যত্র সরে যাওয়ার সুযোগ নেয়। তবে জেলা পুলিশের এক কর্তার দাবি, চোপড়ার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উপরে নিয়মিত নজর রাখা হয়।
পঞ্চায়েত ভোটের হাওয়া ওঠার পর থেকে চোপড়ায় দু’বার গুলি চালানোর ঘটনা ঘটেছে। গত মার্চে দুই তৃণমূল সমর্থককে গুলি করে মারার অভিযোগ ওঠে তৃণমূলেরই একাংশের বিরুদ্ধে। তৃণমূল বিধায়ক হামিদুল অবশ্য বলেন, ‘‘শুধু মুখে বললেই হবে না। কোন চা বাগান প্লট করে বিক্রি করা হয়েছে, সেটা বলা হোক। আর যাঁরা বালির কারবার করেন, তাঁরা সরকারকে কর দেন। কোনও ঘটনার সঙ্গেই তৃণমূলের যোগ নেই। সবই বিরোধীদের চক্রান্ত।’’