গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
জুনিয়র ডাক্তারদের দাবি মেনে রাজ্য সরকার বাধ্যই হয়েছে কলকাতার পুলিশ কমিশনার পদ থেকে বিনীত গোয়েলকে সরাতে। সরাতে হয়েছে ডিসি (নর্থ) অভিষেক গুপ্তকেও। একই সঙ্গে সরিয়ে দিতে হয়েছে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের দুই শীর্ষ আধিকারিককে। কিন্তু এর কোনওটিকেই ‘বড়’ করে দেখছেন না জুনিয়র ডাক্তারেরা। বরং তাঁদের আলোচনায় ‘বড়’ করে উঠে আসছে রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরের প্রধান সচিব নারায়ণ স্বরূপ নিগমকে পাঠানো মুখ্যসচিব মনোজ পন্থের ১০ দফা নির্দেশিকা। জুনিয়র ডাক্তারেরা তো বটেই, সিনিয়র ডাক্তারেরাও বলছেন, সিসিটিভি বা বিশ্রামকক্ষ নয়, সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকদের নিরাপত্তার বিষয়টি অনেক কিছুর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। মুখ্যসচিবের নির্দেশিকায় সেই বিষয়গুলি রয়েছে। যা সবচেয়ে বেশি ‘উল্লেখযোগ্য’। চিকিৎসকেরা এমনও বলছেন যে, যত ক্ষণ না ওই নির্দেশিকার ‘বাস্তবায়ন’ হচ্ছে, তত ক্ষণ ‘নিশ্চয়তা’ নেই। ওই নির্দেশনামা বাস্তবায়িত হলে সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা ক্ষেত্রে সামান্য হলেও বদল দেখা যাবে।
গত বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্যসচিবকে ১০ দফা নির্দেশিকা পাঠিয়েছিলেন মুখ্যসচিব। তার মধ্যে ৭, ৮ এবং ৯ নম্বর নির্দেশকে ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ বলে অভিহিত করছে চিকিৎসক মহলের বড় অংশ। তাতে কী কী রয়েছে? প্রথমত, কোন সরকারি হাসপাতালে এই মুহূর্তে কত বেড খালি রয়েছে, তা যাতে সকলে জানতে পারেন, তার ব্যবস্থা করা এবং তা কেন্দ্রীয় ভাবে দেখভাল করা। দ্বিতীয়ত, যত দ্রুত সম্ভব কেন্দ্রীয় ভাবে ‘রেফারেল সিস্টেম’ চালু করা। তৃতীয়ত, অবিলম্বে ডাক্তার, নার্স এবং টেকনিশিয়ানদের শূন্যপদে নিয়োগ সুনিশ্চিত করা।
চিকিৎসক মহলের বড় অংশের বক্তব্য, এই সবগুলিই চিকিৎসকদের নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত। জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের অন্যতম মুখ দেবাশিস হালদারের কথায়, ‘‘এই আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা জনস্বাস্থ্যের বিষয়গুলিকে সামনে আনতে পেরেছি।’’ তাঁর বক্তব্য, ‘‘রোগীদের সুষ্ঠু পরিষেবা প্রদানের সঙ্গে চিকিৎসকদের নিরাপত্তার বিষয়টি সম্পৃক্ত। নিরাপত্তা শুধু সিসিটিভি, বিশ্রামকক্ষ বা ২৪ ঘণ্টার জন্য খাবারের ক্যান্টিনে সীমাবদ্ধ নয়। মুখ্যসচিবের পাঠানো নির্দেশিকায় এমন কিছু দিকের উল্লেখ রয়েছে, যা দীর্ঘ দিনের দাবি ছিল। আপাতত সেগুলি পাওয়া গিয়েছে।’’ তবে শুধু ‘কাগুজে’ নির্দেশিকা নয়, তাঁরা এর দ্রুত বাস্তবায়নের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন।
জুনিয়র ডাক্তারদের বক্তব্য, কেন্দ্রীয় ভাবে ‘বেড মনিটরিং সিস্টেম’ চালু করা সম্ভব। কারণ, কোভিডের সময়েও সেই প্রক্রিয়াতেই রোগীরা হাসপাতালে ভর্তি হতেন। ‘রেফারেল সিস্টেম’কেও গুরুত্বপূর্ণ বলছেন চিকিৎসক মহলের অনেকে। যা বেড মনিটরিং সিস্টেমের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। বিষয়টি কী? ধরা যাক হুগলির চুঁচুড়া সদর হাসপাতালে এক জন রোগীকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু তাঁর অসুস্থতা এতটাই গুরুতর যে, তাঁকে কলকাতার আরজি কর হাসপাতালে ‘রেফার’ করছেন চুঁচুড়ার ওই হাসপাতালের চিকিৎসকেরা। ‘রেফারেল সিস্টেম’ হল সেই ব্যবস্থা, যাতে চুঁচুড়ার হাসপাতালের চিকিৎসকেরা জানতে পারবেন, ওই রোগীর জন্য আরজি করে বেড আছে কি নেই। জুনিয়র ডাক্তারদের বক্তব্য, যদি বেড না থাকে, তা হলে সংশ্লিষ্ট রোগী আরজি কর হাসপাতালে এলেও পরিষেবা পাবেন না। কিন্তু তার ‘দায়’ চাপবে আরজি করের উপর। ক্রমে তা চিকিৎসকদের নিরাপত্তাকে বিপন্ন করে তুলবে। দেবাশিসের প্রশ্ন, ‘‘বেসরকারি কর্পোরেট হাসপাতালগুলিতে এই ব্যবস্থা চালু থাকতে পারলে সরকারি হাসপাতালে তা করা যাবে না কেন?’’
জুনিয়র ডাক্তারেরা কর্মবিরতি চালাচ্ছেন বলে চিকিৎসা না পেয়ে অনেকের মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করেছিল রাজ্য সরকার তথা শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস। আরজি কর মামলার সুপ্রিম কোর্টের শুনানিতেও সংবাদমাধ্যমের তথ্য উদ্ধৃত করে সে কথা বলেছিলেন রাজ্যের আইনজীবী কপিল সিব্বল। এমনকি, জুনিয়র ডাক্তারদের কর্মবিরতির চলাকালীন ২৯ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে রাজ্য সরকার তাঁদের পরিবারগুলির জন্য দু’লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণও ঘোষণা করেছে। যার প্রেক্ষিতে জুনিয়র ডাক্তারদের বক্তব্য, কর্মবিরতির কারণে মানুষ মারা গিয়েছেন বলে দাবি করা হয়েছে। অথচ, যথাযথ রেফারাল সিস্টেমের অভাবে কত জন রোগীকে রোজ হয়রানি হতে হয়, কত রোগীর মৃত্যু হয় চিকিৎসা না পেয়ে, সরকার তার কোনও তথ্য দেয় না।
জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের অন্যতম দাবি ছিল— শূন্যপদে চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ানদের স্থায়ী নিয়োগ করতে হবে। মুখ্যসচিবের নির্দেশিকায় শূন্যপদে নিয়োগের কথা বলা হলেও ‘স্থায়ী’ শব্দটি নেই। জুনিয়র ডাক্তারদের অনেকের বক্তব্য, স্থায়ী নিয়োগ হলে তিনি যে ভাবে কাজ করবেন, ‘চুক্তিভিত্তিক’ নিয়োগে সেই গুণগত মান ক্ষুণ্ণ হবে। যদিও আপাতত শূন্যপদ পূরণের নির্দেশিকাকেই ‘রুপোলি রেখা’ হিসাবেই দেখতে চাইছে চিকিৎসক মহলের একটি অংশ। তবে প্রত্যেকেই জোর দিচ্ছেন বাস্তবায়নের উপর। বলছেন, এ সব যেন ‘কথার কথা’ হয়েই থেকে না যায়। তাঁদের বক্তব্য, ‘চাপের মুখে’ সরকারের প্রতিশ্রুতি দেওয়া আর তা পূরণ করার মধ্যে বিস্তর ফাঁক থেকে যায়। তার প্রচুর উদাহরণও রয়েছে।
জুনিয়র-সিনিয়র নির্বিশেষে চিকিৎসকদের অনেকে বলছেন, মুখ্যসচিবের ওই নির্দেশিকার বাস্তবায়ন হলে স্বাস্থ্যব্যবস্থায় যে দুর্নীতির পাহাড় জমেছে, তা-ও ভাঙা যাবে। এক চিকিৎসকের বক্তব্য, ‘‘প্রতিটি হাসপাতালে যে দালালচক্র কায়েম হয়েছে, যে ভাবে গ্রুপ ডি পদে শাসকদলের লোক ঢোকানো হয়েছে, তাতে ব্যাপক দুর্নীতি রয়েছে। এর সঙ্গে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তার বিষয়টিও যুক্ত।’’
আন্দোলনের অন্যতম দাবি ছিল স্বাস্থ্যব্যবস্থায় ‘থ্রেট কালচার’ (হুমকি সংস্কৃতি) নির্মূল করা। আন্দোলনকারীদের অনেকেরই বক্তব্য, সেই বিষয় নিয়ে রাজ্য সরকার এখনও ‘রা’ কাড়েনি। তবে তার বাইরেও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অন্তত লিখিত ভাবে আদায় করা গিয়েছে, যা তাঁদের কাছে একেবারেই তুচ্ছ নয়।