মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফাইল ছবি।
বাংলায় শিল্প আসছে। তবে সেই শিল্পের জন্য তাঁর সরকার জোর করে জমি অধিগ্রহণ করবে না। বিধানসভায় মঙ্গলবার এমনটাই জানালেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
এই প্রসঙ্গে তিনি ঘোষণা করেন, ডেউচা পাচামি প্রকল্প নিয়ে মমতার সরকার কোনও জেদাজেদিতে যাবে না, বরং সকলে আস্থা অর্জন করেই শিল্প স্থাপনে উদ্যোগী হবে। মঙ্গলবার বিধানসভায় রাজ্যে শিল্প স্থাপন নিয়ে বক্তৃতায় মমতা টেনে আনেন বামফ্রন্ট সরকারের আমলে ঘটে যাওয়া সিঙ্গুর প্রসঙ্গ। মমতা বলেন, ‘‘এখানে সিঙ্গুরের মতো জেদাজেদি হবে না। সকলের আস্থা অর্জন করেই শিল্প স্থাপনের কাজ হবে। রাজ্য সরকার পুনর্বাসনের প্যাকেজ ঘোষণা করেছে তারপর কারও কোনও বক্তব্য থাকলে তা শোনা হবে। এখানে কোনও ইগোর ব্যাপার নেই। প্রকল্প রূপায়িত হলে বিদ্যুতের দাম কমে যাবে। রাজ্যের মানুষের সুবিধা হবে।’’
প্রসঙ্গত, একটি অংশের বক্তব্য ডেউচা পাচামিতে জমি অধিগ্রহণ নিয়ে সেখানকার স্থানীয়দের একাংশের মধ্যে খানিক অসন্তোষ তৈরি হয়েছিল। অনেকেই জমি দেবেন কি না, তা নিয়ে দ্বিধায় পড়েছিলেন। প্রকল্প যে অঞ্চলে রূপায়িত হবে, তার একটি বড় অংশে আদিবাসীদের বাস। এক সময়ে সেই আদিবাসীদেরই একাংশ উষ্মা প্রকাশ করেন। প্রকল্প নিয়ে তৎকালীন মুখ্যসচিব রাজীব সিংহ মহম্মদ বাজারে বৈঠক করতে গেলে তাঁরা স্মারকলিপিও জমা দেন তাঁর কাছে। পরে যদিও বিষয়টি স্তিমিত হয়ে যায়। সেই আবহেই মুখ্যমন্ত্রীর মঙ্গলবারের ঘোষণা যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। তবে মুখ্যমন্ত্রীর এই প্যাকেজ ঘোষণার পর এলাকাবাসীর একাংশ বলছেন, প্যাকেজ ভাল করে দেখার পরই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
মমতার কথায়, ‘‘ডেউচা পাচামি হল বীরভূম জেলার মহম্মদবাজার হরিণসিংহ কোল ব্লক। এখানে ৩ হাজার ৪০০ একর জমির মধ্যে ১ হাজার ১৭৮ মিলিয়ন হেক্টর জমির তলায় কয়লা, ১ হাজার ১৪৮ মিলিয়ন হেক্টর ব্যাসল্ট জমা রয়েছে। এই ৩ হাজার ৪০০ একরের মধ্যে এক হাজার একর সরকারি জমি। আমরা আগে সরকারি জমিতে কাজ শুরু করব। তারপর ধাপে ধাপে অন্যান্য জায়গায় জমি নেওয়া হবে।’’
রাজ্যের শিল্প সম্ভাবনা প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘‘এ বার বাংলায় শিল্পে এক নতুন উৎসাহ এসেছে। আগামী দিনে শিল্পের জন্য বড় ডেস্টিনেশন হতে চলেছে বাংলা। আবার প্রত্যেকেই উৎসাহ দেখাচ্ছে। ২০ এপ্রিল বিশ্ব বঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলন রয়েছে। আমাদের পুরুলিয়ার রঘুনাথপুরে ৭২ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হচ্ছে। লেদার ইন্ডাস্ট্রিজ গড়তে লখনউ থেকে শিল্পপতিরা এ রাজ্যে চলে আসছেন। আইটি ইন্ডাস্ট্রির জন্য ২০০ একর জমির ওপর কাজ শুরু হচ্ছে।’’
মুখ্যমন্ত্রীর দফতর থেকে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এই সমগ্র এলাকাটিতে বারোটি গ্রামে ৪ হাজার ৩১৪টি বাড়িতে ২১ হাজারের বেশি মানুষ বাস করেন। যার মধ্যে ৩ হাজার ৬০০ জন তফসিলি জাতি এবং ৯ হাজার ৩৪টি তফশিলি উপজাতি রয়েছে। বিপুল কয়লা জমা থাকায় এই এলাকা দেশের সবচেয়ে বড় কোল ব্লকগুলির মধ্যে অন্যতম। এখান থেকে উত্তোলিত কয়লা শুধু জেলা নয়, রাজ্য ও দেশের অর্থনীতির উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে চলেছে। এর ফলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে এক লক্ষের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হবে। রাজ্য সরকার ৩৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে। সমগ্র প্রকল্পটি ধাপে ধাপে করা হবে।
গ্রাফিক— সনৎ সিংহ।
প্রথম ধাপে কাজ হবে দেওয়ানগঞ্জে। সেখানে কম গভীরতায় কয়লা রয়েছে। সমস্ত পক্ষের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে কাজ হবে বলেই জানানো হয়েছে। পাশাপাশি জমিহারা মানুষদের আকর্ষণীয় প্যাকেজ এবং উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন দেওয়া হবে। তাঁদের জমি, বাড়ি এবং পরিবারের এক জনকে চাকরি দেওয়া হবে। ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কাজে। যাঁর ওই এলাকায় বাড়ি-সহ জমি রয়েছে, তিনি বিঘা প্রতি ১০-১৩ লক্ষ টাকা পাবেন। এ ছাড়াও স্থানান্তরকরণের জন্য পাবেন পাঁচ লক্ষ টাকা। কলোনিতে পাবেন ৬০০ বর্গ ফুটের বাড়ি। যে সব পরিবার বাড়ি জমি হারাবে, তাদের একজন জুনিয়র কনস্টেবলের চাকরি পাবে। এমন চাকরি পাবেন ৪ হাজার ৯৪২ জন। প্রায় ৩ হাজার জন শ্রমিক, যাঁরা পাথরভাঙার কাজ করেন, তাঁরা ভরণ-পোষণের জন্য এক লক্ষ ২০ হাজার টাকা পাবেন। ওই এলাকায় ১৬০ জন কৃষি শ্রমিক ৫০ হাজার টাকা পাবেন। ৫০০ দিনের জন্য ১০০ দিনের কাজ পাবেন। ২৮৫ জন পাথর ভাঙার যন্ত্রের মালিক তাঁদের জমি ও পরিকাঠামোর দাম এবং ৫০ হাজার টাকা পাবেন অন্যত্র কাজ সরিয়ে নেওয়ার ক্ষতিপূরণ হিসাবে।ছয় মাস ধরে ১০ ট্রাক ব্যাসল্ট বিনামূল্যে পাবেন। কাছের চাঁদা মৌজায় ব্যাসল্ট শিল্প উদ্যানের পুনর্গঠন হবে। ২৭ জন খাদান মালিক জমি ও বাড়ির দাম পাবেন।