পিচের আস্তরণ উঠে গিয়েছে বর্ষার মুখেই। খোয়া, নুড়ি, স্টোন চিপসের আড়ালে গায়ে-গা লাগিয়ে অগুন্তি গর্ত। দুপুরের এক পশলা বৃষ্টি শেষে ঘোলা জলে টইটুম্বুর সেই সব খানাখন্দ। গাড়ির চাকায় নাগাড়ে কড়মড় শব্দ আর থেকে থেকেই ছিটকে উঠছে ঘোলা জল। মালদহ ঢোকার মুখে কালিয়াচক থেকে চৌরঙ্গি মোড় হাড় জিরজিরে প্রায় অগম্য ওই ২২ কিলোমিটার জাতীয় সড়ক ভেঙে তাঁর বিশ-গাড়ির কনভয় নিয়ে মালদহ পৌঁছেই মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য ছিল, “এর নামও রাস্তা!”
৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের এই ‘দুর্গম’ চেহারা নিয়ে মালদহের বাসিন্দাদের অভিজ্ঞতা নতুন নয়। সোমবার, তাঁর দু’দিনের মালদহ ও দুই দিনাজপুর সফর সে অভিজ্ঞতা দিয়েই শুরু করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
এ দিন দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ধরে মুখ্যমন্ত্রীর কনভয় পালসিট থেকে বর্ধমানের বাজেপ্রতাপপুরের পথ ধরতেই মাথায় বাজ পড়েছিল জেলা প্রশাসনের। বর্ধমান ও পড়শি জেলা বীরভূমের জেলা-কর্তারা এ ওর মুখ চাওয়াচায়ি করেছিলেন রাজ্য সড়কের অবস্থা তো সুবিধার নয়? তবে বর্ধমানের কাটোয়া রোড ধরে মঙ্গলকোট, বীরভূমের নানুর-লাভপুর এবং তার পর বাদশাহী সড়ক ধরে মুর্শিদাবাদের দিকে ছুটে যাওয়ার পথে তাঁর কনভয়ের গতি তেমন শ্লথ হয়নি। মুর্শিদাবাদের সুতি হয়ে ফরাক্কা পর্যন্তও নির্বিঘ্নেই পেরোয় মুখ্যমন্ত্রীর কনভয়।
৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক তার দীর্ণ ‘চেহারা’ তুলে ধরেছিল ফরাক্কা ছাড়ানোর পরেই। কালিয়াচক থেকে মালদহ, জাতীয় সড়কের ওই পরিসরটুকু কার্যত নাচতে নাচতে পার হল মুখ্যমন্ত্রীর কনভয়। ওই রাস্তায় মুখ্যমন্ত্রীর গাড়ির গতি ছিল ১০ থেকে ২০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা। ২২ কিলোমিটার পার হতে কনভয়ের সময় লাগে প্রায় ৫৫ মিনিট। সাধারণ ভাবে যা মিনিট কুড়িতেই পেরোনো যায়।
মালদহ পৌঁছে মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য জানান, তাঁর ‘রেস্ট’ নেওয়ার প্রয়োজন নেই। রাত ৯টা নাগাদ জাতীয় সড়ক ধরে কনভয় ছোটে রায়গঞ্জের দিকে। জেলা প্রশাসন ন্যাশনাল হাইওয়ে কর্তৃপক্ষকে বলে মালদহ-রায়গঞ্জ রাস্তাটুকু চলনসই করিয়ে রেখেছিল। তাই সেখানে তেমন অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তা হলে কালিয়াচকের কাছে রাস্তা মেরামত করানো হল না কেন?
মালদহ জেলা প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীর ট্রেনে মালদহ এসে সড়ক পথে রায়গঞ্জ যাওয়ার কথা ছিল। জাতীয় সড়কের রায়গঞ্জ-মালদহ পরিসরটুকু সারানো হয়। কিন্তু তিনি যে কালিচকের রাস্তা পেরিয়ে আসবেন, তা জানব কী করে?”
ঘটনাচক্রে এ দিনই, ওই জাতীয় সড়কের বেহাল দশার ব্যাপারে ন্যাশনাল হাইওয়ে অথরিটি অব ইন্ডিয়া-কে সাত দিনের মধ্যে হলফনামা দাখিল করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুর এবং বিচারপতি অসীম বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডিভিশন বেঞ্চে। ওই জাতীয় সড়কের ‘দুর্বিষহ’ হাল নিয়ে জনস্বার্থে মামলা দায়ের করেছেন আইনজীবী অঞ্জন ভট্টাচার্য। এ দিন ওই আইনজীবী আদালতে জানান, কলকাতা থেকে মালদহ পর্যন্ত ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের ৩০০ কিলোমিটার রাস্তার অবস্থা শোচনীয়। এনএইচএআই কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদনকারী ২ জুলাই চিঠি দিয়ে জানতে চান, রাস্তা মেরামতি ও সংস্কারের কাজ তিন-চার মাস আগে শেষ হয়েছে। কী ভাবে ওই রাস্তার হাল এত দ্রুত খারাপ হল? রাস্তা মেরামতির কাজ কেন্দ্র করেছে কি না, তাও জানতে চান ওই আইনজীবী।
বিচারপতি অসীম বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন নিজেই বলেন, “মাস খানেক আগে ওই রাস্তায় যাতায়াত করেছি। রাস্তার হাল খুব খারাপ।” এরপরেই প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চের নির্দেশ এনএইচএআই কর্তৃপক্ষ যে হলফনামা দাখিল করবেন, তাতে এ-ও জানাতে হবে যে, রাস্তা সারানো হলে তা কেন তাড়াতাড়ি খারাপ হল। সারাতে কত খরচ হয়, কোন ঠিকাদার সংস্থা রাস্তা সারিয়েছিল ও তাদের বিরুদ্ধে সরকার কী ব্যবস্থা নিয়েছে।
তবে এই প্রথম নয়, মাস আটেক আগেও এই জাতীয় সড়ক নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে রাস্তা মেরামতির নির্দেশ দিয়েছিল হাইকোর্ট। সেই নির্দেশের পরে গর্ত বুজিয়ে প্যাচওয়ার্ক করে পরিস্থিতি সামলায় এনএইচএআই। বর্ষা শুরু হতেই পুরোনো চেহারায় ফিরে গিয়েছে জাতীয় সড়ক। এনএইচএআই কর্তৃপক্ষের দাবি, কলকাতা-ডালখোলা ৪৫৩ কিলোমিটার রাস্তাটি চার লেন করার জন্য ২০০৯-এর কেন্দ্রীয় বাজেটে ২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হয়। কিন্তু জমি জটে রাস্তা সম্প্রসারণ করা যায়নি। তাপ্পি দিয়ে রাস্তা সারাই করলে হাল এমনই হবে বলে তাঁরা জানান। তাঁদের দাবি রাজ্যে পালাবদলের পরে সরকার জমি অধিগ্রহণে বাধা দিচ্ছে।
প্রসঙ্গত, গত ৮ অগস্ট শান্তিপুরের জনসভায় মুখ্যমন্ত্রী জাতীয় সড়কের বেহাল হওয়ার দায় চাপান কেন্দ্রের উপর। তার পরই রানাঘাট শহর লাগোয়া ওই জাতীয় সড়ক ছেয়ে যায় কেন্দ্র-বিরোধী পোস্টার, ফেস্টুনে। এ দিন তা দেখে বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের কটাক্ষ, “জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণের জন্য জমি অধিগ্রহণ করতে গেলেই শাসকদলের কর্মীরা বাধা দেন। আগে নিজের কর্মীদের রোগটা সারান মুখ্যমন্ত্রী।”