বৃষ্টির আকুতি। বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরে। ছবি: শুভ্র মিত্র
বর্গি এসেছিল পশ্চিম থেকেই। প্রাকৃতিক বর্গি ‘লু’ বা গরম হাওয়া পশ্চিম থেকে এলেও গ্রীষ্মে তার রাজ্যপাট সীমাবদ্ধ থাকত মূলত বাংলার পশ্চিমাঞ্চলেই। সেই ‘বর্গি’ এ বার কার্যত সারা গাঙ্গেয় বঙ্গ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তাকে ঠেকাতে পারত যে, সেই জলীয় বাষ্প এ বছর খুব দুর্বল। উপকূলবর্তী জেলাগুলিতে গরমে ঘামের অস্বস্তি ছিল পরিচিত ঘটনা। কিন্তু জলীয় বাষ্পের অভাবে এ বার গ্রীষ্মে গাঙ্গেয় বঙ্গে ঠোঁটফাটা, ত্বকে টান ধরার মতো উপসর্গও দেখা যাচ্ছে। গ্রীষ্মের এই চরিত্রবদলে প্রশ্ন উঠেছে, এত দিন ধরে যে জলবায়ু পরিবর্তনের কথা বলা হচ্ছিল, তা কি এ বার প্রমাণ-সহ হাজির হয়েছে বাংলায়? কারও কারও প্রশ্ন, বঙ্গোপসাগর থেকে জলীয় বাষ্প উধাও হল কেন? তা হলে কি প্রশান্ত মহাসাগরের ‘এল নিনো’-র প্রভাব আগেভাগেই শুরু হয়ে গেল?
আবহবিদদের ভাষায় এল নিনো পরিস্থিতি মানে প্রশান্ত মহাসাগরে জলের উষ্ণতা বৃদ্ধি এবং সেই বর্ধিত উত্তাপ সংলগ্ন ভারত মহাসাগরীয় এলাকার জলীয় বাষ্প টেনে নেয়। তার ফলে ভারতীয় উপমহাদেশে পর্যাপ্ত জলীয় বাষ্পের আকাল দেখা দেয়। কিন্তু প্রশান্ত মহাসাগরে এখনও এল নিনো পরিস্থিতি পুরোপুরি দানা বাঁধেনি। তাই সেই টানে জলীয় বাষ্প শূন্য হয়ে গরম হাওয়ার দাপট বাড়বে, এ কথা নিশ্চিত ভাবে বলা যায় না। কারণ, বর্তমানে প্রশান্ত মহাসাগরের জলের উষ্ণতায় পরিবর্তনের সময় চলছে। ‘লা নিনা’ পরিস্থিতি অর্থাৎ শীতল অবস্থার পর্যায় শেষে উষ্ণতা বাড়ছে। এই উষ্ণতা বাড়তে বাড়তে জুলাই-অগস্ট নাগাদ এল নিনো পরিস্থিতি সাবালক অবস্থায় পৌঁছবে।
পূর্ব ভারতে দীর্ঘ কাল শীর্ষ আবহবিজ্ঞানীর পদে ছিলেন কেন্দ্রীয় আবহাওয়া বিভাগের প্রাক্তন ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল গোকুলচন্দ্র দেবনাথ। তাঁর মতে, এই শুকনো গরমের জন্য দায়ী ভারতের পশ্চিমে থাকা বিভিন্ন দেশ থেকে আসা গরম হাওয়া। এই সময়ে বঙ্গোপসাগরে উচ্চচাপ বলয় তৈরি হয়। সেখান থেকেই বাংলা, ওড়িশা, অন্ধ্র উপকূলে প্রবল জলীয় বাষ্প ঢোকে। এ বার গরম হাওয়া এতই তীব্র যে, তাকে ঠেলে জলীয় বাষ্প ঢুকতেই পারছে না। এই ধরনের গরম যে পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমাঞ্চল ছাড়া বাকি জেলায় অস্বাভাবিক, তা-ও জানিয়েছেন তিনি। এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতি কেন? ওই প্রবীণ আবহবিজ্ঞানী বলেন, “আমার মনে হয়, যে-জলবায়ু বদলের কথা বলা হচ্ছে, এটা তারই প্রমাণ।” তবে বিরুদ্ধ মতও আছে। আবহবিজ্ঞানীদের একাংশ বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন একটা স্থায়ী ঘটনা। এক বছরের শুকনো গরম দেখেই জলবায়ু বদল বলে দেগে দেওয়া ঠিক হবে না।
শুকনো হাওয়ার দাপাদাপি নিয়ে কেন্দ্রীয় আবহাওয়া বিভাগের জলবায়ুবিদ্যা বিভাগের প্রাক্তন প্রধান বিজ্ঞানী পুলক গুহঠাকুরতার বক্তব্য, এ বার বঙ্গোপসাগরে তেমন জোরালো উচ্চচাপ বলয় তৈরিই হয়নি। তাই পর্যাপ্ত জোলো হাওয়া ঢুকছে না। তার ফলেই বাধাহীন ভাবে দেদার গরম হাওয়া ঢুকছে পশ্চিম দিক থেকে। তাতেই এই অস্বাভাবিক গরম।
অনেকের প্রশ্ন, শনিবার থেকে অল্পবিস্তর মেঘ দেখা গিয়েছিল। আর্দ্রতাও কিছুটা বেড়েছে। তবে কি শুকনো গরম কমবে? আবহবিদেরা জানিয়েছেন, বঙ্গোপসাগর থেকে সামান্য কিছু জলীয় বাষ্প ঢুকে উপকূলীয় এলাকায় মেঘ তৈরি করেছে। তাই আর্দ্রতাও বেড়েছে। তবে শুকনো গরমের হাত থেকে এখনই রেহাই পাওয়ার সম্ভাবনা নেই।