চন্দ্রকান্ত কুমার। ছবি: ফেসবুক থেকে সংগৃহীত।
গ্রহ-নক্ষত্র না দেখেই ছেলের নাম চন্দ্রকান্ত রেখেছিলেন হুগলির মধুসূদন কুমার ও তাঁর স্ত্রী অসীমাদেবী। তবে ছেলের জীবনে সত্যিই সত্যিই চাঁদ ঢুকে পড়বে, কল্পনাও করেননি তাঁরা। কিন্তু কাজে করে দেখিয়েছেন চন্দ্রকান্ত। আক্ষরিক অর্থেই নিজের নাম সার্থক করেছেন তিনি। কারণ তাঁর তৈরি অ্যান্টেনাই এখন চাঁদ ও মঙ্গলের বুকে ইসরোর প্রধান ভরসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওই অ্যান্টেনার মাধ্যমেই পৃথিবীর কক্ষপথ ছাড়িয়ে সৌরমণ্ডল থেকে বার্তা পাঠাবে ভারতের চন্দ্রযান-২।
হুগলির গুড়াপের খাজুরদহ-মিল্কি পঞ্চায়েতের শিবপুর গ্রামে বাড়ি চন্দ্রকান্ত কুমারের। তাঁর প্রথম স্কুল মাজিনান প্রাথমিক বিদ্যালয়। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েন মাজিনান নব বিদ্যালয়ে। ১৯৯২ সালে খাজুরদহ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাশ করেন। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন ধনিয়াখালি মহামায়া বিদ্যামন্দির থেকে। এর পর বেলুড় রামকৃষ্ণ মিশন থেকে পদার্থবিদ্যায় বিএসসি অনার্স। রেডিয়ো ফিজিক্স অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স নিয়ে এমএসসি এবং এমটেক পাশ করেন রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ থেকে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি-ও করেন। তার পর ২০০১ সালে ইসরোর চাকরিতে ঢোকেন। ভারতের ‘চন্দ্রযান-২’ মিশনের ডেপুটি প্রজেক্ট ডিরেক্টর(টেকনিক্যাল)চন্দ্রকান্ত।তাঁর ভাই শশীকান্ত কুমারও বেঙ্গালুরুতে ইসরোয় কর্মরত। তাঁর বিষয় ‘মাইক্রোওয়েভ’।
সংসারে অভাব অনটন থাকেই। তা সামলেও দুই ছেলেকে মানুষের মতো মানুষ করেছেন মধুসূদনবাবু ও অসীমাদেবী। ছেলের এই সাফল্যে যারপরনাই খুশি তাঁরা। তবে গোটা দেশ যখন আনন্দে আত্মহারা, তখন অনেক বেশি মাটির কাছাকাছি এই পরিবার। আজও শিবপুরের ওই বাড়িতেই থাকেন মধুসূদন বাবু ও অসীমাদেবী। পাল্টায়নি রোজনামচাও। ছেলেরা সুপ্রতিষ্ঠিত হলেও, চাষবাস এবং হোমিওপ্যাথি নিয়ে পড়াশোনায় ব্যস্ত মধুসূদনবাবু। ঘর-গোয়াল সামলান অসীমাদেবী।
আরও পড়ুন: প্রথম ধাপ সফল, চালু ক্রায়োজেনিক ইঞ্জিন, পৃথিবীর কক্ষপথে পৌঁছে গেল চন্দ্রযান-২
দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের ধারেই শিবপুর গ্রামে চন্দ্রকান্তের বাড়িতে ঢোকার মুখে আজও দাঁডি়য়ে রয়েছে ধানের মড়াই, কাঁঠাল গাছ, কয়েকটি ফুলগাছ। শান-বাঁধানো উঠোনে রোদে শুকোচ্ছিল কাঁঠাল-বীজ। ৬৬ বছর বয়সেও গরুর গা ধুইয়ে দেন মধুসূদনবাবু। ছেলেক নিয়ে প্রশ্ন করলে জানান, ‘‘কিছু না ভেবেই দুই ছেলের নামের সঙ্গে চাঁদ জুড়েছিলাম। বড়ছেলে চন্দ্রযানে কাজ করার সুযোগ পাওয়ায় খুব খুশি আমরা।’’ তিনি আরও জানান, ‘‘ একটা সময় গয়না বন্ধক দিয়ে কলেজের বেতন মিটিয়েছি। কিন্তু সুদে-আসলে সব কষ্ট পূরণ করে দিয়েছে দুই ছেলেই।’’ অসীমাদেবী বলেন, ‘‘ছেলেদের সব প্রয়োজন মেটাতে পারিনি হয়ত। তবে চেষ্টার ত্রুটি রাখিনি। ওরা আমাদের মুখ উজ্জ্বল করেছে।’’
তবে ছেলেরাও যে কম কষ্ট করেনি, তা জানাতে ভোলেননি স্বামী-স্ত্রী। তাঁদের কথায়, স্কুলে পড়ার সময় থেকেই ফাঁকা সময়ে চন্দ্রকান্ত বাবাকে চাষের কাজে সাহায্য করতেন। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বাবার কাছেই পড়েছেন তিনি। উচ্চশিক্ষার খরচ চালাতে একসময় টিউশনও করেছেন। তাই ১৫ জুলাই উড়ানের কিছু ক্ষণ আগে যখন চন্দ্রযান -২ অভিযান বাতিল করা হয়, তখন মুষড়ে পড়েন মধুসূদনবাবু ও অসীমাদেবী। সংবাদমাধ্যমে মধুসূদনবাবু জানান, ‘‘অভিযান বাতিল হওয়ার পর খুব দুঃখ পেয়েছিলাম আমরা। কিন্তু চন্দ্রযান-২ উৎক্ষেপণে শামিল হতে পেরেছে ছেলে। ওকে নিয়ে গর্ববোধ করছি আমরা।’’
এর আগে, ২০১৪ সালে ভারতের মঙ্গল অভিযানেও শামিল ছিলেন চন্দ্রকান্ত। মঙ্গলযানের অ্যান্টেনাও তাঁরই হাতে তৈরি।
আরও পড়ুন: চাঁদের ভেলা পৌঁছে দেবে নতুন দিগন্তে, রুখবে ব্রেন ড্রেন, বাড়াবে বাণিজ্যও!
কিন্তু মহাকাশযানে অ্যান্টেনার কাজ কী?
উন্নত প্রযুক্তির দৌলতে আজকাল যে কোনও সময়, পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারি আমরা। টেলিফোনে কথা বলতে পারি প্রিয়জনের সঙ্গে। আবার কোথাও কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে, মুহূর্তের মধ্যে তা ফুটে ওঠে টেলিভিশনের পর্দায়। এ সব কিছুই সম্ভব হয় রেডিও ফ্রিকোয়েন্সির (রেডিও কম্পাঙ্ক) মাধ্যমে। রেডিও থেকে দৃশ্যমান আলো হয়ে অতিবেগুনি (আল্ট্রাভায়োলেট), এক্স-রে, গামা-রে, তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ আলোর বর্ণালীর (স্পেকট্রাম) ব্যাপ্তি এতটাই। তার মধ্যে খুব সামান্য একটা অংশকে আমরা দেখতে পাই। তাকেই বলা হয় দৃশ্যমান আলো। আর কোনও কিছুই আমরা খালি চোখে দেখতে পাই না। যাদের খালি চোখে দেখতে পাই না, তাদের মধ্যেই পড়ে রেডিও, এক্স-রে, গামা-রে। আর যেহেতু সেগুলি এগিয়ে চলে তরঙ্গের মতো, তাই তার যেমন তরঙ্গদৈর্ঘ্য (ওয়েভলেংথ্) থাকে, তেমনই থাকে কম্পাঙ্ক। যার তরঙ্গদৈর্ঘ্য যত বেশি হয়, তার কম্পাঙ্ক তত কম। কম্পাঙ্ক কম মানে তার শক্তি কম।
ইসরোর গ্রাউন্ড স্টেশনের সঙ্গে প্রতি মুহূর্তে কথা বলার খুব প্রয়োজন হয় মহাকাশে থাকা যানগুলির। খুব দরকার হয়, মহাকাশযানগুলি কী জবাব দিচ্ছে, তা শোনার। তারা কী বার্তা পাঠাচ্ছে, তা পড়ে দেখার, দ্রুত। চাঁদ, মঙ্গলের মুলুকে যেতে অতটা দূরত্ব পাড়ি দিতে গিয়ে তো বিগড়ে যেতেই পারে মহাকাশযান, তার শরীর-স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে পারে, তখন তা কী ভাবে জানতে পারবে ইসরোর গ্রাউন্ড স্টেশন?
তখনই দরকার পড়ে চন্দ্রকান্তের তৈরি অ্যান্টেনার, যা রেডিও ফ্রিকোয়েন্সিকে ধরে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পাঠিয়ে দিতে পারে। তবেই গ্রাউন্ড স্টেশন জানতে পারে, মহাকাশযানটি কী অবস্থায় রয়েছে? সেটি ঠিক মতো কাজ করছে কি না। সেই মহাকাশযানে থাকা অ্যান্টেনাগুলি কী বলতে চাইছে, কী ধরনের বার্তা পাঠাচ্ছে, গ্রাউন্ড স্টেশন তা বুঝতে পারে, ডিকোড করতে পারে। প্রয়োজনে ‘কমান্ড’ বা নির্দেশ পাঠাতে পারে মহাকাশযানে। এই অ্যান্টেনা ছাড়া মহাকাশে ওই যানগুলি যেমন দিশাহারা, তেমনই মহাকাশযানের অ্যান্টেনা বিগড়ে গেলে বিপদে পড়ে যায় গ্রাউন্ড স্টেশন।