ফাইল চিত্র।
ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ঠিকঠাক শিক্ষা দেওয়ার জন্য স্কুলে শিক্ষক নিয়োগে কোনও ধরনের অবহেলা করা উচিত নয় বলে কলকাতায় মন্তব্য করলেন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান। এসএসসি বা স্কুল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ তোলপাড় শুরু হওয়ার পরে এই প্রথম কোনও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মুখ খুললেন। তিনি জানান, কয়েকটি রাজ্যে শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম হয়েছিল এবং সেই বিষয়ে ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়েছে। এ দিনই চাকরির দাবিতে শহিদ মিনার চত্বরে রিলে অনশন কর্মসূচিতে স্কুলের শারীরশিক্ষা-কর্মশিক্ষার শিক্ষকপদ প্রার্থীদের পাঁচ জন অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁদের এসএসকেএম (পিজি) হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে।
কলকাতায় একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসেছিলেন ধর্মেন্দ্র। এসএসসি-র নিয়োগ-দুর্নীতি নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘‘শিক্ষা বিষয়টি যৌথ তালিকাভুক্ত। শুনেছি, এ রাজ্যের এসএসসি চাকরিপ্রার্থীদের দাবিদাওয়া নিয়ে কলকাতা হাই কোর্টে মামলা হয়েছে। বিষয়টি বিচারাধীন। তাই এই বিষয়ে মন্তব্য করা ঠিক নয়। তবে এসএসসি-র নিয়োগের বিষয়টি রাজ্য সরকারেরই আন্তরিক ভাবে দেখা দরকার।’’ এর প্রতিক্রিয়ায় তৃণমূলের মুখপাত্র তাপস রায় বলেন, ‘‘রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে সরকার যথেষ্ট সচেতন। এ ব্যাপারে অন্তত বিজেপির নেতৃত্বাধীন কোনও সরকারের কোনও পরামর্শের প্রয়োজন নেই আমাদের। আইনি বিষয় হোক বা প্রশাসনিক, রাজ্য এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তার সমাধানে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করবে।’’
এসএসসি কাণ্ড নিয়ে সিবিআই তদন্ত শুরু করলেও কলকাতা হাই কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের নির্দেশে তা আপাতত স্থগিত রয়েছে। শুধু শিক্ষক নন, স্কুলে ‘গ্রুপ সি’ বা তৃতীয় শ্রেণি এবং ‘গ্রুপ ডি’ বা চতুর্থ শ্রেণির কর্মী নিয়োগেও ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ। এসএসসি ছাড়াও তাতে নাম জড়িয়েছে তাদের উপদেষ্টা কমিটি, এমনকি রাজ্যের তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী (বর্তমানে শিল্পমন্ত্রী) পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত সচিবেরও।
গত নভেম্বর থেকে এসএসসি-র দুর্নীতি নিয়ে হাই কোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাসে পরপর মামলা হয়েছে। প্রথম থেকেই তিনি সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিতে শুরু করেন। রাজ্য সরকারও ক্রমাগত আপিল করতে থাকে। বেশ কয়েক বার বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশ স্থগিত করে দেয় ডিভিশন বেঞ্চ। ক্ষুব্ধ বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এবং কলকাতা হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতির কাছে অভিযোগ জানান।
শেষে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশেই প্রথমে স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির কর্মী নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে তদন্ত শুরু করে সিবিআই। ডিভিশন বেঞ্চের নির্দেশে পরে তা-ও স্থগিত হয়ে যায়। তৃতীয় শ্রেণির স্কুলকর্মী এবং স্কুলশিক্ষক নিয়োগ মামলাতেও সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। তদন্ত শুরু করে সিবিআই এসএসসি-র উপদেষ্টা কমিটির প্রধান শান্তিপ্রসাদ সিংহ এবং অন্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে শুরু করে। যদিও এই মামলায় এখনও কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি।
এর মধ্যে একটি মামলায় সরাসরি নাম জড়িয়ে যায় রাজ্যের তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং তাঁকেও সিবিআইয়ের সামনে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। এমনকি সিবিআই প্রয়োজনে পার্থবাবুকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে বলেও জানান তিনি। রাজ্য সরকার তার বিরুদ্ধে ডিভিশন বেঞ্চে আবেদন করার পরে ১৩ মে পর্যন্ত সিবিআইয়ের যাবতীয় তদন্তের উপরে স্থগিতাদেশ দেয় ডিভিশন বেঞ্চ। ফলে এখনই আর পার্থবাবুকে সিবিআইয়ের সামনে হাজির হতে হচ্ছে না।
বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের একের পর এক এমন নির্দেশে সমাজের বিভিন্ন স্তরে প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। এমনকি হাই কোর্টের আইনজীবীদের একাংশ যে-‘নজিরবিহীন’ বিক্ষোভ দেখিয়েছেন, তার সঙ্গেও বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের সাম্প্রতিক নির্দেশের সম্পর্ক উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
রবিবার সেই পুরো বৃত্তান্তের সঙ্গে জুড়ে যায় কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রীর মন্তব্য। তার সঙ্গে নতুন মাত্রা যোগ করেছে এসএসসি-র চাকরির দাবিতে অনশন কর্মসূচিতে এ দিন পাঁচ চাকরিপ্রার্থীর অসুস্থ হয়ে পড়ার ঘটনা। দিনশেষে অনশনকারীরা জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁদের দাবি পূরণের আগে পর্যন্ত তাঁরা এই বিক্ষোভ ও রিলে অনশন চালিয়ে যাবেন। রবিবার তাঁদের রিলে অনশন কর্মসূচি ১০ দিনে পড়ল।
বিক্ষোভকারীরা জানান, সকালে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালীঘাটের বাড়িতে তাঁদের চার প্রতিনিধি স্মারকলিপি দিতে গেলে সিভিক ভলান্টিয়ারেরা তাঁদের আটকে দেন। তাঁদের লালবাজারে নিয়ে গিয়ে আটকও করা হয়। তাঁদের মুক্তির দাবিতে ধর্মতলায় মিছিল বেরোয়।
শহিদ মিনার চত্বরে গিয়ে দেখা যায়, প্রখর রোদে প্রচণ্ড গরমের মধ্যে ফুটপাতে শুয়ে আছেন কয়েক জন অনশনকারী। তাঁরা জানান, তাঁদের বার্তা কোনও ভাবেই মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পৌঁছতে দেওয়া হচ্ছে না।
এসএফআইয়ের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক সৃজন ভট্টাচার্য এ দিন অনশন মঞ্চে বসে অভিযোগ করেন, ‘‘আন্দোলনকারীদের যে-সব প্রতিনিধি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন, তাঁদের গলা চেপে ধরে সিভিক ভলান্টিয়ারেরা বলেছেন, ‘আনিস খান বানিয়ে দেব’, ‘রেপ করে দেব’। এটা কি জঙ্গলরাজ নয়? মুখ্যমন্ত্রী এতই ব্যস্ত যে, ওঁদের দাবিদাওয়াগুলো বিচার করে দেখার জন্য একটু সময় হল না!’’ এসএসসি-র চেয়ারম্যান সিদ্ধার্থ মজুমদার বলেন, ‘‘অনশনকারীদের প্রতিনিধিরা আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। বিষয়টি সহানুভূতির সঙ্গে খতিয়ে দেখা হচ্ছে।"