ফাইল চিত্র।
মাঝের সাত বছরে অনেকখানি বদলে গিয়েছে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নকশা। অনেক বেশি শীতল হয়েছে প্রতিবেশী চিনের সঙ্গে সম্পর্ক। অতিমারির ধাক্কা পুরোদস্তুর কাটিয়ে উঠতে এখনও ঢের দেরি অর্থনীতিরও। এই পরিস্থিতিতে সাত বছরের দীর্ঘ টানাপড়েন শেষে রাজ্যের ‘চিকেন নেক’ করিডর বলে পরিচিত অংশটির পরিকাঠামো মজবুত করতে প্রায় হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে কেন্দ্র। শুধু তা-ই নয়, ২০২২-২৩ অর্থবর্ষের জন্যও কেন্দ্রীয় বরাদ্দ এক লাফে প্রায় ছ’গুণ হওয়ার ‘সিদ্ধান্তের’ কারণে পরিকাঠামো উন্নয়নে জোর কদমে কোমর বাঁধছে নবান্ন।
আর্থিক বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, আদালতের ডিএ-নির্দেশ থেকে শুরু করে লক্ষ্মীর ভান্ডার-সহ নানা কল্যাণ প্রকল্প— বিভিন্ন ক্ষেত্রে পাহাড়প্রমাণ খরচের প্রয়োজনীয়তার দরুন পরিকাঠামো খাতে মোটা টাকা জোগানো কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে রাজ্যের পক্ষে। অথচ তৃতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে শিল্পকে পাখির চোখ করতে মমতা-সরকারের জন্য তা একান্ত জরুরি। এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রের এই টাকা পরিকাঠামো উন্নয়নে রাজ্যকে স্বস্তি দেবে বলেই অভিমত তাঁদের। যদিও প্রশাসনিক পর্যবেক্ষকদের অনেকের মতে, মূলত ‘চিনের চাপেই’ এই পদক্ষেপ করতে হল কেন্দ্রকে।
শিলিগুড়ির ‘চিকেন নেক’ করিডর উন্নয়ন প্রকল্প দ্রুত কার্যকর করতে কেন্দ্রীয় সড়ক ও পরিবহণমন্ত্রী নীতিন গডকড়ীর সঙ্গে কথা বলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই খাতে প্রায় ৯৯৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে কেন্দ্রীয় সড়ক ও পরিবহণ মন্ত্রক। তা দিয়ে কাজ করবে রাজ্যের পূর্ত দফতর। উত্তরবঙ্গের ওই রাস্তাটি ইসলামপুর থেকে শিলিগুড়ি হয়ে কোচবিহার পর্যন্ত গিয়েছে।
সড়ক পরিবহণ ও হাইওয়ে মন্ত্রক সূত্রের খবর, ২০২০-২১ আর্থিক বছরের তহবিল থেকে ২৩৭ কোটি টাকা এ রাজ্যের পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ হয়েছিল। সেখানে ২০২১-২২ অর্থবর্ষে তা এক ধাক্কায় তা বেড়ে হয়েছে ১,৪১১ কোটি টাকা। শুধু ‘চিকেন নেক’ করিডরেই ৯৯৫ কোটি। ২০২২-২৩ সালে কেন্দ্রের ঘর থেকে বিভিন্ন পরিকাঠামো প্রকল্পে প্রায় সাড়ে ছ’হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ অনুমোদন পাওয়া যাবে বলে আশা রাজ্যের। তবে প্রকল্পগুলির জন্য জমি জোগানোর কথা তাদেরই।
মন্ত্রক সূত্রের খবর, ২০১৪-১৫ সাল থেকে শিলিগুড়ির ‘চিকেন নেক’ করিডরের পরিকাঠামো সংস্কারের পরিকল্পনা চলছিল। পশ্চিমবঙ্গের এই অংশ নেপাল, ভুটান এবং পুরো উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে যোগসূত্র। চিন, বাংলাদেশের সীমান্তও এই অংশের খুব কাছে। ফলে কৌশলগত অবস্থানের দিক থেকে এই অংশের গুরুত্ব অপরিসীম। সিদ্ধান্ত হয়েছে, ওই অংশের ১১.৭ কিলোমিটার চার থেকে ছয় লেনে সম্প্রসারিত হবে। এই দূরত্বের মধ্যে চার কিলোমিটারে থাকবে উড়ালপথ (এলিভেটেড করিডর)। সমান্তরালে বালাসন ও মহানন্দা বড় সেতু আর চামটা ও পাঁচনইয়ে ছোট সেতু পুরো পরিকাঠামোকে এক সুতোয় বাঁধবে।
এর পাশাপাশি, জাতীয় সুরক্ষার প্রশ্নে আর একটি কৌশলগত অবস্থানে থাকা পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে সেবক-রংপো (সিকিমগামী রাস্তা) পর্যন্ত প্রায় ৫২ কিলোমিটার পথে ধস সমস্যার স্থায়ী সমাধানে ১,২০০ কোটি টাকার পরিকল্পনা তৈরি হচ্ছে। এ রাজ্য থেকে সিকিমগামী জাতীয় সড়ক-১০ সংস্কারের জন্য প্রাথমিক ভাবে ১০০ কোটি টাকাও মঞ্জুর হয়েছে। বাকি টাকা আসার কথা এই আর্থিক বছরে।
এক কর্তার কথায়, ‘‘চিকেন নেক করিডরের আওতায় থাকা শিলিগুড়ি শহরের ভিতর দিয়ে যাওয়া রাস্তাটি এখন সাত মিটার চওড়া। বালাসন নদীর আগে পর্যন্ত এশিয়ান হাইওয়ে-২ রাস্তাটি চওড়া করার কাজ ২০১৯-২০ অর্থবর্ষে শেষ হয়েছে। এ বার শিলিগুড়ি করিডরের এই ১১.৭ কিলোমিটার রাস্তাটি চওড়া করার কাজটি শুরু হবে।’’
ওই কর্তার সংযোজন, ‘‘কেন্দ্র চাইছে, এমন সড়ক পরিকাঠামো প্রস্তুত রাখতে, যা দিয়ে প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর গাড়ি, এমনকি সাঁজোয়া গাড়িও অনায়াসে চলাচল করতে পারে। এই প্রকল্পের টেন্ডার করবে কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহণ মন্ত্রক এবং কাজ করবে পশ্চিমবঙ্গ পূর্ত দফতর।’’
এর সঙ্গে চলছে ২০২২-২৩ সালের পরিকাঠামো-পরিকল্পনা তৈরির কাজও। যার আর্থিক মূল্য প্রায় ৬,৫০০ কোটি টাকা। তার মধ্যে রয়েছে নন্দকুমার-দিঘা পথে রামনগর বাইপাস, নন্দকুমারের কিছুটা দূরে নরঘাট সেতু, ফরাক্কা থেকে বিহার সীমানা পর্যন্ত জাতীয় সড়ক ৮০-র সম্প্রসারণ, জাতীয় সড়ক ১৩১এ-র মালদহ থেকে বিহার সীমানা পর্যন্ত সম্প্রসারণ, জাতীয় সড়ক ৬০-তে রানিগঞ্জ ও দুবরাজপুর বাইপাস প্রকল্পের পরিকল্পনা। বীরভূমের নলহাটি-মোড়গ্রাম পর্যন্ত প্রায় ১০০ কোটির সড়ক প্রকল্পও উল্লেখযোগ্য। এক কর্তার কথায়, ‘‘প্রকল্পগুলির জন্য প্রয়োজনীয় জমি পাওয়া গেলেই কেন্দ্র টাকা দেবে রাজ্যকে।’’
রাজ্যের রাজকোষে ‘টানাটানির সংসারের’ প্রেক্ষিতে প্রশাসনের এক শীর্ষ কর্তার অভিমত, ‘‘এখন রাজ্য সরকার কেন্দ্রের কোনও অর্থ ছাড়তে নারাজ। যেখান থেকে কেন্দ্রের যে টাকা পাওয়া সম্ভব, তা নিশ্চিত করতে বলা হচ্ছে দফতরগুলিকে। সে দিক থেকে কেন্দ্রের থেকে এই অর্থলাভের সুযোগ নিশ্চিত করতে উপযুক্ত পদক্ষেপই করবে রাজ্য।’’