গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে ‘সুপার কপ’ রাজীব কুমারের পিছনে ধাওয়া করে বেদম সিবিআইয়ের ‘দুঁদে-বাঘা’ অফিসাররা! অথচ রাজীবকে পাকড়াও করা দূরে থাক, তার টিকির নাগালও এখনও পাননি কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা।
দৌড়ে দৌড়ে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা এতটাই ক্লান্ত যে, ‘অপারেশন রাজীব’-এর জন্য দিল্লি-উত্তরপ্রদেশ থেকে উড়িয়ে আনা ১৪ জন আধিকারিকের মধ্যে ১০ জনকেই ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হল দিল্লিতে, সিবিআই সদর দফতরে। সিবিআই সূত্রের খবর, বাকিদেরও ফেরত পাঠানো হবে। তা হলে কি রাজীবকে ধরার আশা ছেড়ে দিয়েছে সিবিআই?
অথচ রাজ্যের গোয়েন্দা প্রধানকে গ্রেফতার করতে কী না করেছেন গোয়েন্দারা! রীতিমতো মাথা খাটিয়ে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা ‘অপারেশন রাজীব’-এর ছক সাজিয়েছিলেন। এক দিকে নবান্নে চিঠি, অন্য দিকে আদালতে গ্রেফতারি পরোয়ানার আবেদন— সাঁড়াশি সেই চাপের মধ্যেই রাজ্য জুড়ে একের পর এক হানা। কিন্তু তার পরেও, আক্রমণের ত্রহ্যস্পর্শ কাটিয়ে ‘মেঘনাদ’ হয়ে রয়েছেন ‘আরকে’ (এই নামেই আইপিএস মহলে তিনি বেশি পরিচিত)।
রাজীব কুমারের সন্ধানে তল্লাশি সিবিআই আধিকারিকদের। নিজস্ব চিত্র
আরও পড়ুন: কাশ্মীর নিয়ে সুর কতটা চড়াবে পাকিস্তান? রাষ্ট্রপুঞ্জে আজ রাতে মোদী, ইমরানের ভাষণ
কলকাতা পুলিশের এক শীর্ষ কর্তা (যিনি রাজীব ঘনিষ্ঠ বলে আদৌ পরিচিত নন) কয়েক দিন আগে আলোচনা প্রসঙ্গে হঠাৎই প্রশ্ন করে বসলেন, ‘‘আচ্ছা সিবিআই কি সত্যিই রাজীব কুমারকে অ্যারেস্ট করতে চাইছে?’’ হঠাৎ এ রকম প্রশ্ন কেন? ওই পুলিশ কর্তার জবাব, ‘‘আরে ভাই, আমিও তো জীবনে অনেক রেড করেছি। হাই প্রোফাইল অপারেশনও করেছি। কোনও দিন সঙ্গে এক ডজন সাংবাদিককে সঙ্গে নিয়ে যাইনি। যে কোনও অপারেশনের মূল মন্ত্র গোপনীয়তা। সেই গোপনীয়তাই যদি না থাকে তা হলে অপারেশন কী ভাবে সফল হবে!’’
একই কথা বললেন রাজ্য পুলিশের এক শীর্ষ কর্তা। তিনি বলছেন, ‘‘বিমল গুরুংকে ধরতে যখন সিকিমের রিসর্ট বা চা-বাগানে অপারেশন হয়েছে, সংবাদ মাধ্যম দূরে থাক, বাহিনীর অধিকাংশ সদস্যই কিছুই জানতে পারেননি।”
সিবিআই কর্তারা রাজ্য পুলিশের ওই দুই কর্তার তোলা প্রশ্ন উড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁদের দাবি, সিবিআই বদ্ধপরিকর রাজীবকে ধরতে। তাই অনেক প্রশাসনিক জটিলতার ঝুঁকি নিয়েও তারা আইপিএস মেস, কলকাতা পুলিশের বডিগার্ড লাইনস থেকে শুরু করে পাঁচতারা হোটেলের রান্নাঘরেও সেঁধিয়ে গিয়েছেন।
রাজীব কুমারের সন্ধানে হোটেলে তল্লাশি সিবিআই আধিকারিকদের। নিজস্ব চিত্র
আরও পড়ুন: শিশুমৃত্যু-কাণ্ডে ‘নির্দোষ’ কাফিল খান, যোগী সরকারকে ক্ষমা চাইতে বললেন চিকিৎসক
সিবিআই কর্তারা এই দাবি করতেই পারেন। কারণ, তথ্য বলে, ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে রাজীবকে ধরার তোড়জোড় শুরু হয়। সে দিনই নবান্নে মুখ্যসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব এবং ডিজি-কে চিঠি পাঠায় সিবিআই। আটঘাট বেঁধে ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয় আসল অপারেশন। যখন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দিল্লিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সঙ্গে বৈঠকে ব্যস্ত, তখন এ রাজ্যে সল্টলেকের পূর্ত ভবনের ক্যাম্প অফিস থেকে বেরিয়ে পড়েছে সিবিআই-এর দু’টি দল। একসঙ্গে হানা দেয় তারা পার্ক স্ট্রিটে রাজীবের সরকারি বাসভবনে এবং আলিপুরের আইপিএস মেসে। সেখান থেকে রুবির মোড়ে একটি পাঁচতারা হোটেলের রান্নাঘর। এর পর থেকে টানা শহর ও রাজ্যের একের পর এক হোটেল, রিসর্ট, এমনকি বজবজের এক অখ্যাত নার্সিংহোমেও পৌঁছে গিয়েছে সিবিআই।
রাজ্য পুলিশের এক প্রাক্তন ডিজি যিনি এই বিতর্ক থেকে নিজের নাম দূরে রাখতে চান, প্রশ্ন তুলছেন, ‘‘সিবিআই কি আদৌ রাজীবকে ধরার কোনও হোমওয়ার্ক করেছে?’’ তাঁর দাবি, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের কাজ দেখে মনে হচ্ছে কোনও হোমওয়ার্কই নেই। তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘‘কোনও অভিযুক্তকে ধরতে গেলে আগে ঠিক করতে হয়, কোথায় কোথায় তিনি গা ঢাকা দিয়ে থাকতে পারেন। এর পর শুরু হয় ইলেকট্রনিক সার্ভিল্যান্স, সোজা কথায় মোবাইল এবং ফোনে নজরদারি। রাজীবের মতো দক্ষ পুলিশ অফিসার সেই সুযোগ দেবেন না এটা জানা কথা। সে ক্ষেত্রে নজর রাখতে হয় তাঁর ঘনিষ্ঠ লোকজনের উপর, যাঁদের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ করতে চাইবেনই।”
রাজীবকে ধরার জন্য যখন হন্যে হয়ে ঘুরছে সিবিআই, তখনও আইনি লড়াই কিন্তু চালিয়ে গিয়েছেন ওই পুলিশ কর্তা। এমনকি ওকালতনামাতেও পাওয়া গিয়েছে আরকে-র সই। তা হলে এটা স্পষ্ট যে, তিনি হাতে গোনা কিছু লোকজনের সঙ্গে কোনও না কোনও ভাবে যোগাযোগ রাখছেন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে পরবর্তী পদক্ষেপ নির্দিষ্ট করছেন। এখানেই প্রশ্ন, সিবিআই কি গত এক সপ্তাহে সেই ঘনিষ্ঠদের চিহ্নিত করে তাঁদের উপর নজরদারি শুরু করতে পেরেছে? এক প্রাক্তন পুলিশ কর্তার কথায়, ‘‘গোটাটা দেখে তো কেমন ছোটবেলার কানামাছি খেলার মতো লাগছে।’’
আরও পড়ুন: শনিবার নারদা কাণ্ডে হাজিরা দেবেন মুকুল, মির্জাকে সামনে রেখেই জেরা করতে চায় সিবিআই
রাজ্য পুলিশের এক আধিকারিক শুক্রবার হাসতে হাসতে বলেন, ‘‘গোটা পুলিশ বিভাগ জানে, রাজীবের মামলা থাকলেই কোন ইনস্পেক্টর, কোন সাব ইনস্পেক্টর বা কোন ডিএসপি কোর্টে হাজির থাকছেন। আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলছেন। যদিও তাঁদের ওখানে থাকার কোনও ডিউটি নেই।” রাজ্য পুলিশের ওই আধিকারিক বলেন, ‘‘ওই আধিকারিকরা কেন যাচ্ছেন, সেই খোঁজ কি নিয়েছে সিবিআই?”
রাজ্য পুলিশেরই অন্য এক আধিকারিক এ দিন আরও একটি তথ্য দেন। তিনি বলছেন, ‘‘জানেন কি, এডিজি সিআইডি-র চান্দৌসির পৈত্রিক বাড়িও তালাবন্ধ?” উত্তরপ্রদেশের সম্বল জেলার চান্দৌসি শহরের একটু বাইরে রাজীব কুমারের পৈত্রিক বাড়ি ‘আনন্দ ভবন’। অধ্যাপক বাবা আনন্দ কুমারের নামে কয়েক বিঘে জমির উপর বিশাল সেই বাড়ি। সেখানেই থাকেন তাঁর বৃদ্ধা মা মুন্নিদেবী। সিবিআই আধিকারিকরাও স্বীকার করেছেন, বাড়ির কাজের লোক ছাড়া কেউ নেই সেই বাড়িতে। কেউ জানেন না মুন্নিদেবী কোথায়! আইপিএস মহলের অনেকেই জানেন যে, রাজীব মায়ের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন। অথচ মুন্নিদেবী কোথায় তা জানতেও পারেনি সিবিআই!
আর এই সব তথ্য প্রকাশ্যে আসতেই রাজ্য প্রশাসন থেকে শুরু করে সিবিআইয়ের অন্য শাখাগুলোতেও জল্পনা চলছে, গ্রেফতার নয়— তাড়া করে, সামাজিক সম্মানে আঘাত হেনে, পলাতক প্রমাণ করে রাজীবকে কোণঠাসা করাটাই কি স্ট্র্যাটেজি?
আরও পড়ুন: তিন দিনেও শেষ হল না শুনানি, সোমবার পর্যন্ত ঝুলেই রইল রাজীবের আবেদন
সিবিআই আধিকারিকরা যদিও এ ব্যাপারে মুখে কুলুপ এঁটেছে।