তখন হাসপাতালে নিখিলবাবু। ফাইল চিত্র
সরকারি দফতরে ঘুরে, জুতোর সুখতলা ক্ষইয়েও মেলেনি অবসরকালীন সুবিধা। ফলে অধরাই থেকে গিয়েছে ব্যয়সাপেক্ষ ক্যানসার চিকিৎসা। প্রাপ্য অধিকার পেতেও কেন গাফিলতির শিকার হতে হবে! স্বাস্থ্য প্রশাসনকে কাঠগড়ায় তুলে এই প্রশ্নেরই উত্তর চাইছে এক প্রবীণ সরকারি চিকিৎসকের মৃত্যু।
অসুস্থতার জন্য স্বেচ্ছাবসর নিয়েছিলেন ক্যানসারে আক্রান্ত ইএনটি-র শল্য চিকিৎসক নিখিলচন্দ্র রায় (৬২)। তাঁর কেমোথেরাপির জন্য প্রয়োজন ছিল ৩৫ লক্ষ টাকা। ভরসা ছিল অবসরকালীন সুবিধা বাবদ প্রাপ্য অর্থটুকু। সেই টাকা আদায়ের জন্য গত পাঁচ মাস ধরে লড়াই চালাচ্ছিলেন নিখিলবাবুর স্ত্রী অণিমা বন্দ্যোপাধ্যায় রায়। ফাইল চালাচালির সঙ্গে লড়াইয়ে হার মানতে হল তাঁকে। বুধবার সকালে মালদহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যু হয়েছে নিখিলবাবুর।
পারিবারিক সূত্রে জানা গিয়েছে, অস্থিমজ্জা ও রক্তে ক্যানসার ছিল নিখিলবাবুর। বছর তিনেক আগে অসুখ ধরা পড়ার পরে স্বেচ্ছাবসর চেয়ে আবেদন করেন তিনি। দীর্ঘ টালবাহানা পেরিয়ে গত জুন মাসে সেন্ট্রাল মেডিক্যাল বোর্ড সেই আবেদন মঞ্জুর করে। জুলাইয়ে তা স্বাস্থ্যভবনের অনুমোদন পায়।
নিখিলবাবু মালদহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন। তাই অবসরকালীন সুযোগসুবিধার জন্য সেখানকার সুপার তথা উপাধ্যক্ষের কার্যালয়ে প্রয়োজনীয় সব নথি জমা করে তাঁর পরিবার। নিয়ম অনুযায়ী, সুপারের অফিসের মাধ্যমে অবসরকালীন ফাইল বিবাদী বাগে প্রিন্সিপাল অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেলের (এজি ওয়েস্ট বেঙ্গল) দফতরে পৌঁছয়। কাগজপত্র খতিয়ে দেখে প্রাপ্য অর্থ পেতে এর পর খুব বেশি দেরি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু তা হয়নি।
অণিমাদেবী এ দিন জানান, কেন দেরি হচ্ছে তা জানতে অক্টোবরে এজি ওয়েস্ট বেঙ্গলের কার্যালয়ে যান তাঁদের ছেলে অর্ণব রায়। আধিকারিকেরা অর্ণবকে জানান, আবেদনের নথিতে ত্রুটির কারণে তা মালদহের সুপারের অফিসে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। অণিমার কথায়, ‘‘আমরা সব নথি দিয়েছিলাম। ছেলে মালদহে সুপারের অফিসে গেলে ওকে বলা হয়, আধিকারিকেরা ছুটির আবেদন হারিয়ে ফেলেছেন!’’ সার্ভিস বুক-সহ প্রয়োজনীয় নথি নতুন করে তৈরি করে গত ১৯ নভেম্বর প্রিন্সিপাল অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেলের দফতরে পাঠান মালদহ মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ। নিখিলবাবুর পরিবার জানিয়েছে, এর পর ওই দফতর থেকে তাঁরা জানতে পারেন, পুরো প্রক্রিয়া শেষ হতে আরও দু’মাস লাগবে। এরই মধ্যে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের জেরে নিখিলবাবুর মৃত্যু হয়।
অণিমা বলেন, ‘‘টাকাটা পেলে চিকিৎসা করাতে পারতাম। কয়েক জন আধিকারিকের গাফিলতির জন্য স্বামীকে হারালাম।’’ ‘‘এজি বেঙ্গল থেকে আপত্তি জানিয়ে ফাইল যে ফেরত এসেছে, তা পরিবারকে জানানো হয়নি কেন’’ — প্রশ্ন তুলেছেন প্রবীণ ক্যানসার চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়। মালদহ মেডিক্যাল কলেজের সুপার অমিত দাঁ অবশ্য বলেন, ‘‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে কিছু করা হয়নি। চিকিৎসকের পরিবারের সঙ্গে এমন কিছু ঘটেছে, আমি জানতাম না। আমার সঙ্গে কথা বললে উদ্যোগী হয়ে সমস্যার সমাধান করতাম। পরিবারটি যদি লিখিত ভাবে তাদের বক্তব্য জানায়, তা হলে তা খতিয়ে দেখব। অভিযোগের সারবত্তা পাওয়া গেলে নিশ্চয়ই ব্যবস্থা নেব।’’
অন্য দিকে, এই ঘটনা আইনের চোখে অমার্জনীয় অপরাধ বলে মনে করছেন কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী কল্লোল বসু। তিনি বলেন, ‘‘সুপ্রিম কোর্ট একাধিক বার বলেছে, পেনশন, অবসরকালীন ভাতা, প্রভিডেন্ট ফান্ড এক জন কর্মীর অধিকার। তা দিয়ে সরকার কোনও দয়া করছে না। যে চিকিৎসক সারা জীবন সাধারণ মানুষকে পরিষেবা দিলেন, তিনি নিজে অসুস্থতার সময় প্রাপ্য অধিকারটুকু পেলেন না, এটা মেনে নেওয়া যায় না। যাঁদের গাফিলতিতে এটা হল, তাঁদের চিহ্নিত করে ওই চিকিৎসকের পরিবারকে যথেষ্ট পরিমাণে ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত।’’
চিকিৎসক সংগঠন ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস ফোরামের সম্পাদক কৌশিক চাকীর প্রশ্ন, ‘‘এ রাজ্যে চোলাই মদে মৃত্যু হলে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। তা হলে কারও গাফিলতিতে এক জন চিকিৎসক শেষ সময়ে চিকিৎসা না পেয়ে মারা গেলে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না কেন?’’