কলকাতা হাই কোর্ট। —ফাইল চিত্র।
পঞ্চায়েত ভোটে বেআইনি কাজের জন্য এক বিডিও এবং এক এসডিও-কে সাসপেন্ডের নির্দেশ দিয়েছে কলকাতা হাই কোর্ট। পরিস্থিতি যা, তাতে আগামী দিনে আরও কয়েক জন বিডিও-র ঘাড়ে শাস্তির খাঁড়া নামার আশঙ্কা করছে প্রশাসনিক মহলের একাংশ। ভোট প্রক্রিয়ায় বেশ কয়েক জন বিডিও-র ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন রাজ্যের বিরোধী নেতারাও। সব মিলিয়ে পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিডিওদের অনেকের ভূমিকাই আতশকাচের নীচে। এই পরিস্থিতিতে বিডিওদের পাশে থাকার বার্তা দিল রাজ্য প্রশাসনের সর্বোচ্চ মহল।
সম্প্রতি সমস্ত জেলাশাসক, মহকুমাশাসক এবং বিডিওদের নিয়ে প্রশাসনিক বৈঠকে বসেছিলেন রাজ্যের মুখ্যসচিব হরি কৃষ্ণ দ্বিবেদী। সূত্রের খবর, ওই বৈঠকে বিডিওদের ‘আতঙ্কিত’ না হয়ে কাজ করতে বলেছে প্রশাসনের শীর্ষ মহল। পাশে থাকার আশ্বাস ছাড়াও প্রয়োজনে আইনি লড়াইয়ে সাহায্যের বার্তাও দেওয়া হয়েছে তাঁদের। শুধু তা-ই নয়, ওই আইনি লড়াইয়ের বিষয়ে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা করা হচ্ছে বলেও খবর।
বিডিওদের উদ্দেশে শীর্ষ মহলের এই বার্তাকে বিশেষ ভাবে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন প্রশাসনিক অলিন্দের অনেকে। তাঁদের মতে, প্রশাসনিক কাঠামোয় বিডিও পদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শাসক দলের সঙ্গে ‘ঘনিষ্ঠতা এবং ভোটে তাদের প্রতি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগে’ বিডিওদের মনে যদি শাস্তি পাওয়ার আশঙ্কা জন্মায় এবং প্রশাসনে তা সংক্রমিত হয়, তা হলে তা সরকার কিংবা শাসক দলের কাছে সুখকর হবে না। সম্প্রতি পঞ্চায়েত ভোট পর্বে যে ভাবে বিডিওদের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হচ্ছে, তাতে তাঁদের অনেকের মনে আশঙ্কার মেঘ ঘনানো অযৌক্তিক নয় বলেও মনে করছে প্রশাসনের একাংশ।
সদ্য সমাপ্ত পঞ্চায়েত ভোটে বিডিওদের একাংশের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠেছে। কোথাও বিদেশে থেকে শাসক দলের প্রার্থীর মনোনয়নপত্র গ্রহণ, কোথাও তৃণমূলের প্রার্থীকে ভুয়ো জাতিগত শংসাপত্র প্রদান, কোথাও গণনায় কারচুপি কিংবা ভোট লুটে বাধা না-দেওয়া— এ রকম একের পর এক অভিযোগে বিদ্ধ হয়েছেন বিডিওরা।
উলুবেড়িয়ার এসডিও শমীককুমার ঘোষ এবং উলুবেড়িয়া-১ ব্লকের বিডিও নীলাদ্রিশেখর দে-র বিরুদ্ধে শাসক দলের প্রার্থীকে ভুয়ো শংসাপত্র দেওয়া এবং বিরোধী দলের প্রার্থীকে হারানোর ষড়যন্ত্রের কথা আদালত নিযুক্ত অনুসন্ধান কমিটি বলেছে। তার ভিত্তিতে ওই দু’জন-সহ মোট তিন অফিসারকে সাসপেন্ড করার নির্দেশ দিয়েছেন বিচারপতি অমৃতা সিংহ।
মিনাখাঁর বিডিও-র বিরুদ্ধে বিদেশে থাকা প্রার্থীর মনোনয়ন জমা নেওয়ার জন্য আদালতের নির্দেশে সিআইডি তদন্ত চলছে। হাওড়া জগাছায় ভোট-গণনায় কারচুপির অভিযোগে সেখানকার বিডিও-কে আদালতে হাজিরা দিতে হয়েছে। আদালতে হাজিরা দিয়েছেন পূর্ব মেদিনীপুরের রামনগরের বিডিও-ও। ঝালদার বিডিও এবং যুগ্ম-বিডিওর বিরুদ্ধেও অভিযোগ উঠেছে।
অভিজ্ঞ অফিসারদের অনেকের মতে, সরকারি অফিসারদের হয়ে সাধারণত সরকারি কৌঁসুলিরা সওয়াল করেন। প্রয়োজনে কোনও ব্যক্তি পোড়খাওয়া আইনজীবীদের নিয়োগ করতে পারেন। আবার সরকারও চাইলে, বিশেষ কোনও আইনজীবীকেও নিয়োগ করতে পারে। এ ক্ষেত্রে সম্ভবত বিডিওদের মামলা লড়ার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ আইনজীবীদের নিয়োগ করতে পারে। তবে সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, ব্যক্তিগত ভাবে বেআইনি কাজে অভিযুক্ত হলে, সংশ্লিষ্ট অফিসাররের হয়ে অভিজ্ঞ আইনজীবীর সওয়ালের খরচ কেন জনগণের কোষাগার থেকে দেওয়া হবে? তা হলে কি প্রশাসনের অন্দরে সরকার তথা শাসক দলের ‘আনুগত্য’ বজায় রাখতে এই সিদ্ধান্ত?
আধিকারিকদের অনেকে ব্যক্তিগত স্তরে মেনে নিচ্ছেন যে, বিভিন্ন মামলায় প্রশাসনের নিচুতলার অফিসারেরা যে ভাবে রাজনৈতিক পক্ষপাতের অভিযোগে বিদ্ধ হচ্ছেন ও তার জেরে আদালতের রোষে পড়ছেন, তাতে চিন্তার কারণ আছে। নিচুতলার অফিসারেরা হতোদ্যম হয়ে পড়লে, বহু ক্ষেত্রে সরকারি প্রকল্পের গতি মুখ থুবড়ে পড়তে পারে। লোকসভা ভোটের আগে তা হওয়া সরকারের পক্ষে স্বস্তিদায়ক হবে না। ভোট পরিচালনার ক্ষেত্রেও শাসক দলের আশঙ্কার কারণ হতে পারেন ‘বিক্ষুব্ধ’ অফিসারেরা।
আইনজীবী মহলের একাংশের মতে, বহু ক্ষেত্রেই বিডিও এবং অন্য অফিসারেরা যে ভাবে নিয়ম ভেঙে কাজ করেছেন, তাতে আইনি লড়াই সরকারের পক্ষে খুব মসৃণ হবে না। বরং ভোট নিয়ে যা মামলা হয়েছে, তার ধাক্কা সামলাতে সরকারি অফিসারদের নাজেহাল হওয়ার সম্ভাবনা। বিভিন্ন মামলার গতিপ্রকৃতি দেখে আইনজীবীদের একাংশের অনুমান, আগামী দিনে আরও কয়েক জন সরকারি অফিসারকে ‘বিপদে’ পড়তে হতে পারে।