কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে পঞ্চায়েত ভোট করানোর নির্দেশ দিল কলকাতা হাই কোর্ট। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
কেন্দ্রীয় বাহিনীর নজরদারিতেই রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচন হবে। বৃহস্পতিবার এমন নির্দেশই দিল কলকাতা হাই কোর্ট। একই সঙ্গে এ-ও বলা হল যে, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই রাজ্যের সব ক’টি জেলায় মোতায়েনের জন্য কেন্দ্রীয় বাহিনী চেয়ে কেন্দ্রের কাছে আবেদন জানাতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। বৃহস্পতিবার হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম এবং বিচারপতি উদয় কুমারের ডিভিশন বেঞ্চে রাজ্যের পাশাপাশি আলাদা আলাদা ভাবে আর্জি জানিয়েছিল রাজ্য নির্বাচন কমিশন এবং বিরোধী দলগুলি। রাজ্য এবং কমিশনের আবেদন ছিল প্রায় একই— পঞ্চায়েত মামলায় হাই কোর্টের আগের রায় ‘পুনর্বিবেচনা’র আবেদন জানিয়ে তারা বলেছিল, আদালত যেন কেন্দ্রীয় বাহিনী সংক্রান্ত নির্দেশটি আরও এক বার ভেবে দেখে। কারণ, এখনও পর্যন্ত ‘স্পর্শকাতর এলাকা’ চিহ্নিত করা যায়নি। অন্য দিকে, বিরোধী বিজেপি আদালতে জানতে চেয়েছিল, হাই কোর্ট যে অবিলম্বে নির্বাচন কমিশনকে স্পর্শকাতর এলাকাগুলিতে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করার কথা বলেছিল, তার অর্থ কী? এই সব ক’টি আবেদনই একযোগে দুপুর ২টো থেকে শুনতে শুরু করে কলকাতা হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বে়ঞ্চ। বিকেল সাড়ে ৩টে নাগাদ শুনানি শেষ হয়। কিন্তু রায়দান স্থগিত রেখেছিল আদালত। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার কিছু পরে রায় ঘোষণা হয়। সেখানেই কমিশনকে সুস্পষ্ট নির্দেশ দিয়ে দেয় আদালত।
ডিভিশন বেঞ্চের নির্দেশ
হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ বৃহস্পতিবারের রায়ে জানায়, বুধবার হাই কোর্ট যে নির্দেশ দিয়েছিল তা নিয়ে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের কোনও পদক্ষেপ আদালতের চোখে পড়েনি। আইনশৃঙ্খলার দিক থেকে দেখলে কমিশন এখনও স্পর্শকাতর কোনও এলাকা চিহ্নিত করতে পারেনি। কমিশন আরও দু’দিন সময় চেয়েছে। আদালত মনে করছে, সময় যত গড়াবে পরিস্থিতি তত খারাপ হবে। তাই কমিশনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, রাজ্যের সমস্ত জেলায় মোতায়েনের জন্য কেন্দ্রের কাছে কেন্দ্রীয় বাহিনী চেয়ে আবেদন জানাতে হবে। আদালতের এই নির্দেশ ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কার্যকর করতে হবে। কমিশনের আবেদন মতো বিনা খরচে কেন্দ্রীয় বাহিনী পাঠাতে হবে কেন্দ্রীয় সরকারকে। তার কোনও খরচ রাজ্য সরকার বহন করবে না। কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের পাশাপাশি বৃহস্পতিবার ভোট কর্মীদের নিয়েও একটি নির্দেশ দিয়েছে কলকাতা হাই কোর্ট। আদালত কমিশনকে বলেছে, সমস্ত ভোটকর্মীর জন্য সচিত্র পরিচয়পত্রের ব্যবস্থা করতে। কোনও পর্যবেক্ষক বা নিরপত্তাকর্মী যখনই ওই পরিচয়পত্র দেখতে চাইবেন, তখনই তা তাঁদেরকে দেখাতে হবে। একই সঙ্গে আদালত নির্দিষ্ট ভাবে বলে দিয়েছে, ওই পরিচয়পত্র ভোটকর্মীরা কোথাও সরিয়ে রাখলে চলবে না। ভোটের প্রক্রিয়া চলাকালীন ওই পরিচয়পত্র প্রদর্শন করে রাখতে হবে।
প্রধান বিচারপতির পূর্বাভাস
অবশ্য এই রায় যে হতে চলেছে, তার আভাস দুপুরেই দিয়েছিলেন কলকাতা হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি। বৃহস্পতিবার যখন রাজ্য এবং কমিশন আলাদা আলাদা ভাবে তাঁর এজলাসে কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে রায় পুনর্বিবেচনার আর্জি পেশ করেছিল এবং স্পর্শকাতর এলাকা চিহ্নিত করা হয়নি তাই আরও সময় লাগবে বলে জানিয়েছিল তখনই তিনি বলেছিলেন, ‘‘স্পর্শকাতর বুথ নিয়ে যদি কমিশন সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে, তবে আদালত গোটা রাজ্যেই কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের নির্দেশ দিয়ে দিচ্ছে।’’ এমনকি, মনোনয়ন ঘিরে অশান্তির উল্লেখ করে আদালত এও বলেছিল যে, ‘‘পঞ্চায়েত মামলা নিয়ে আদালতের আগের রায় কার্যকর করার ব্যবস্থা না করা হলে বেঞ্চ নিশ্চুপ দর্শকের মতো বসে থাকবে না।’’ সন্ধে সাড়ে ছ’টার কিছু পরে যখন প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ রায় ঘোষণা করল, দেখা গেল সেই আভাসই ফলপ্রসূ হয়েছে।
রাজ্যের আবেদন
রাজ্যের তরফে বৃহস্পতিবার হাই কোর্টে উপস্থিত ছিলেন আইনজীবী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি প্রধান বিচারপতির কাছে আর্জি জানান, ৭টি স্পর্শকাতর জেলায় কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করার নির্দেশ দিয়েছে আদালত। কিন্তু স্পর্শকাতর এলাকাই এখনও চিহ্নিত হয়নি। তাই এই রায় পুনর্বিবেচনা করা হোক। প্রধান বিচারপতি পাল্টা জানতে চান, রাজ্য নির্বাচন কমিশনের আইনজীবী কোথায়? কমিশনের পরিবর্তে রাজ্য এটা নিয়ে কী ভাবে আর্জি করতে পারে? কল্যাণ তখন জানান, ইতিমধ্যে ৮ রাজ্য থেকে পুলিশ চাওয়া হয়েছে। তাই কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে রায় বিবেচনা করে দেখা উচিত হাই কোর্টের। এ প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতি জানান, রায় মেনে না নিলে চ্যালেঞ্জ করা যেতে পারে। প্রয়োজনে স্বতঃপ্রণোদিত মামলা করতে পারে আদালত। এই ভাবে শুধু সময় নষ্ট হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন বিচারপতি। কল্যাণ তখন পাল্টা যুক্তি দেন, সাধারণ মামলাকে পঞ্চায়েত ভোটের অশান্তির সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। এমনকি, ২০০৩ সালের পঞ্চায়েত ভোটের প্রসঙ্গ টেনে এনে রাজ্যের আইনজীবী জানান, ২০০৩ সালে পঞ্চায়েত ভোটে অনেককে হত্যা করা হয়। কারা পশ্চিমবঙ্গে রাজনীতির এমন সংস্কৃতি নিয়ে এসেছে, সে প্রশ্নও তোলেন কল্যাণ। এর পরেই তিনি বিচারপতিকে বলেন, ‘‘আমি অনুরোধ করব, নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তাই এমন কোনও মন্তব্য বা নির্দেশ দেবেন না যাতে কোনও রাজনৈতিক দল তার ফায়দা তুলতে পারে।’’
কমিশনের আবেদন
স্পর্শকাতর বুথ নিয়ে রাজ্যের আবেদনের পর রাজ্য নির্বাচন কমিশনও জানায়, এ বিষয়ে তাদের অবস্থান জানাতে কিছুটা সময় লাগবে। কারণ, স্পর্শকাতর বুথ নিয়ে এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি। এ কথা শুনে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘‘ঠিক আছে। আমরা তা হলে কেন্দ্রীয় বাহিনী সারা রাজ্যের জন্য বলে দিচ্ছি।’’ এর পর কমিশনকে তার ‘নিরপেক্ষ ভাবমূর্তি’র কথা মনে করিয়ে দিয়ে বিচারপতি বলেন, ‘‘নিজেদের নিরপেক্ষ ভাবমূর্তি বজায় রাখবেন। মনোনয়ন ঘিরে অশান্তির খবর আসছে। জবাবে কমিশন কিছু না বললেও প্রধান বিচারপতির সংযোজন, ‘‘আমি কমিশনকে উপদেশ দেওয়ার জন্য বসে নেই। আপনারা উচ্চ আদালতে যান। আপনাদের হাতে উচ্চ আদালতে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু আপনারা যদি আমাদের নির্দেশকে কার্যকর না করার মতো পরিস্থিতি তৈরি করেন, তা হলে আমরা নিশ্চুপ দর্শক হয়ে বসে থাকব না। বিভিন্ন জায়গায় ১৪৪ ধারা জারি রয়েছে। পুলিশ পদক্ষেপ করুক।’’
বিরোধীদের আবেদন
বৃহস্পতিবার বিরোধীরাও আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিল। বিজেপি আদালতে জানায়, তারা জনস্বার্থ মামলার রায়ের ব্যাখ্যা চাইছে। আদালত অবিলম্বে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের নির্দেশ দিয়েছিল। অথচ তা পালন করা হয়নি। রাজ্যের জেলায় জেলায় অশান্তি ছড়িয়ে পড়ছে বলেও অভিযোগ করে বিজেপি। গেরুয়া শিবিরের আইনজীবী হিসাবে আদালতে ছিলেন প্রিয়ঙ্কা টিবরেওয়াল। তিনি আদালতকে বলেন, ‘‘ভোট পরবর্তী হিংসায় কী হয়েছে আশা করি আপনি জানেন। মনোনয়ন জমা দিতে দেওয়া হচ্ছে না। মহিলাদের মারধর করা হয়েছে। আমি উত্তর দিনাজপুরে ছিলাম। এসপি-কে কত বার ফোন করেছি। কিছু হয়নি। কেন এই ভোট? এটা বাংলার শিক্ষা? নির্বাচন করার মতো পরিস্থিতি কি রয়েছে?’’ পরে চোপড়ায় মনোনয়ন জমা নিয়ে অশান্তিতে বিরোধী পক্ষের অন্য দুই আইনজীবী আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। আইনজীবী সুদীপ্ত দাশগুপ্ত বলেন, ‘‘সব জেলায় কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা হোক। পরিস্থিতি খুবই চিন্তাজনক।’’ আইনজীবী শামিম আহমেদ বিচারপতিকে বলেন, ‘‘এমন সব ঘটনা ঘটছে, প্রতি মুহূর্তে আমরা আতঙ্কিত হয়ে উঠছি। চোপড়ার ভিডিয়ো আপনাকে দেখাতে পারি।’’
তৃণমূল যা বলল
কলকাতা হাই কোর্টের রায়ের পর বৃহস্পতিবার তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেন, ‘‘কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা নিয়ে সরাসরি কোনও মন্তব্য করব না। কিন্তু সারা দেশে একটিই নিয়ম হওয়া উচিত। সাধারণ ভাবে লোকসভা এবং বিধানসভা নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করে কেন্দ্রীয় কমিশন। তাই নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকে কেন্দ্রীয় বাহিনী। আবার পঞ্চায়েত আর পুরসভার ভোট হয় রাজ্য নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে। তাই সেখানে নিরাপত্তার দেখাশোনা করে রাজ্যের বাহিনী।’’ কুণালের দাবি, বিরোধীরা পরিকল্পিত ভাবে দু’একটি ঘটনা ঘটিয়ে, নাটক করে, রক্তপাত ঘটিয়ে আদালতকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছে। এবং তার পরেই এই কেন্দ্রীয় বাহিনীর নির্দেশ দিয়েছে আদালত। আদালতের এই সিদ্ধান্ত গোটা দেশে যে নিয়ম প্রচলিত, তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হল কি না তা খতিয়ে দেখা দরকার বলে মন্তব্য করেন কুণাল। একই সঙ্গে তিনি জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় বাহিনীকে তৃণমূল ভয় পায় না। দলের এই নিয়ে মাথাব্যথাও নেই। তাঁর কথায়, ‘‘বিধানসভা নির্বাচনের সময়েও কেন্দ্রীয় বাহিনী, ৮ দফায় ভোট, অফিসার বদলি এই সব করেও তৃণমূলকে আটকানো যায়নি। তারা বিরাট ভাবে জিতেছে। তাই পঞ্চায়েত ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী এল না কি হোম গার্ড দিয়ে ভোট করানো হল, এ সব কোনও বিষয় নয়। তৃণমূলই জিতবে। কারণ বিরোধীদের সঙ্গে মানুষ নেই।’’
বিরোধীরা যা বলল
পঞ্চায়েত ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের দাবিতে হাই কোর্টে জনস্বার্থ মামলা করেছিলেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। আদালত বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় বাহিনীর নজরদারিতে পঞ্চায়েত ভোটের নির্দেশ দেওয়ায় মিনিট দশেকের মধ্যেই সাংবাদিক বৈঠক করেন তিনি। সেখানে শুভেন্দু বলেন, ‘‘এই রায়ের ফলে পশ্চিমবঙ্গে যে মৃত্যু মিছিল শুরু হয়েছিল, আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা হলে এবং তারা যথাযথ পদক্ষেপ করলে তা থেমে যাওয়া উচিত।’’ তবে একই সঙ্গে হাই কোর্টের আগের রায়কে নির্বাচন কমিশন এবং রাজ্য যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়নি বলেও মন্তব্য করেন তিনি। সংগ্রামী যৌথ মঞ্চও আদালতের রায়কে স্বাগত জানিয়েছে। তাদের দাবি পূরণ হওয়ায় আর ভোটের কাজ করতে যেতে কোনও বাধা রইল না বলে জানিয়েছেন ওই মঞ্চের সদস্যেরা।
বিচারপতি মান্থার নির্দেশ
পঞ্চায়েত ভোটে মনোনয়ন জমা দেওয়ার শেষ দিনে একটি মামলা হয় হাই কোর্টে। ভাঙড়-সহ দুই ২৪ পরগনার একাধিক কেন্দ্রে মনোনয়ন জমা দেওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ করে বৃহস্পতিবার হাই কোর্টে বিজেপি, আইএসএফ এবং সিপিএম ওই মামলা করে। বিচারপতি রাজাশেখর মান্থার এজলাসে উঠেছিল সেই মামলা। দুপুর ১২টা নাগাদ সেই মামলার শুনানিতে বিচারপতি মান্থা নির্দেশ দেন, মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার জন্য বিরোধী শিবিরের প্রার্থীদের একটি জায়গায় জড়ো করতে হবে। সেখান থেকে তাঁদের পাহারা (এসকর্ট) দিয়ে মনোনয়ন কেন্দ্র পর্যন্ত নিয়ে যাবেন সংশ্লিষ্ট থানার ওসি। যদিও সেই নির্দেশ পালন করতে গিয়ে ভাঙড়ের বিজয়গঞ্জ বাজারে মনোনয়ন জমা দিতে যাওয়া প্রার্থীদের উপর গুলি চালানো হয় বলে আইএসএফের অভিযোগ। যদিও পুলিশ এ প্রসঙ্গে সরকারি ভাবে কোনও মন্তব্য করেনি।