গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
বালেশ্বরের দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে উদ্বিগ্ন গোটা দেশ। অনেক প্রাণ কেড়ে নিয়েছে করমণ্ডল এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনা। এখনও পর্যন্ত ২৮৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। জখমদের মধ্যে আশঙ্কাজনক অনেকেই। কিন্তু রেল যদি সর্বশেষ ক্যাগ (কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল) রিপোর্টকে গুরুত্ব দিত তবে কি এই মারাত্মক দুর্ঘটনা এড়ানো যেত? এমন প্রশ্ন ওঠা অমূলক নয়।
২০২১ সালের মার্চে শেষ হওয়া অর্থবর্ষের যে রিপোর্ট ক্যাগ জমা দেয় তার মধ্যে আলাদা করে ছিল ট্রেনের লাইনচ্যুত হওয়া সংক্রান্ত বিষয়। সেখানে দেখা হয়েছে ৬৩ শতাংশ ক্ষেত্রে সঠিক সময়ের মধ্যে রেল বেলাইন হওয়ার রিপোর্ট জমাই পড়েনি। কোন রেলের এলাকায় কত জায়গায় বেলাইন হওয়ার তদন্ত দরকার ছিল এবং কত জায়গায় হয়েছে তার বিস্তারিত বলা ছিল ওই রিপোর্টে। সেখানে দেখা যাচ্ছে মোট ৩৫০ জায়গায় তদন্ত হওয়া দরকার থাকলেও তা হয়েছে ১৬৯ জায়গায়। ১৮১টি ক্ষেত্রে কোনও তদন্ত রিপোর্ট জমাই পড়েনি।
বালেশ্বরে যে দুর্ঘটনা তা দক্ষিণ পূর্ব রেলের আওতাধীন। মোট ৩২টি জায়গায় তদন্ত দরকার থাকলেও হয়েছে মাত্র ১৬টি জায়গয়। অর্থাৎ, ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে তদন্ত রিপোর্ট জমা পড়েনি। একই অবস্থা পূর্ব রেলের ক্ষেত্রেও। ৪৮ জায়গায় তদন্তের দরকার থাকলেও রিপোর্ট জমা পড়ে ২৪টির। রিপোর্ট বলা হয়েছিল, দেশের সর্বত্র সব রেল মিলিয়ে ৩০ থেকে ১০০ শতাংশ ক্ষেত্রে তদন্ত না হওয়ার নজির রয়েছে।
২০১৭ থেকে ২০২১ সালের রিপোর্টে বলা রয়েছে শেষ ৪ বছরে মোট ২১৭টি ছোট, বড় রেল দুর্ঘটনা হয়েছে। এর মধ্যে ৭৫ শতাংশ ক্ষেত্রে কারণ ট্রেন বেলাইন হওয়া। বালেশ্বরের রেল দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে, সিগন্যালের সমস্যার কারণেই অঘটন। ক্যাগ রিপোর্ট আগেই জানানো হয়েছিল চার বছরে ২১১টি দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে সিগন্যাল সংক্রান্ত সমস্যা ছিল।
ক্যাগ রিপোর্টে ত্রুটির উল্লেখ ও পরামর্শ। ছবি: সংগৃহীত।
রিপোর্টে এমনটাও দাবি করা হয় যে, রেললাইনের গঠনগত অবস্থা, গতির সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো শক্তি ইত্যাদি খতিয়ে দেখার জন্য যে ‘ট্র্যাক রেকর্ডিং কারের’ পরিদর্শন চলে, তা নিয়মিত হয়নি। ট্র্যাক রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যে সফটওয়্যার নির্ভর ‘ট্র্যাক ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’ রয়েছে তাতে সঠিক নজরদারি ছিল না।
ক্যাগ এমনটাও বলে যে, ২০১৭-১৮ অর্থবর্ষ থেকে ১ লক্ষ কোটি টাকার ‘রাষ্ট্রীয় রেল সুরক্ষা কোষ’ গঠিত হয়। সেই টাকা দিয়ে নানা গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে খরচ করার কথা। কিন্তু সে সব ক্ষেত্রে খরচে রাশ টানা হয়েছে। নতুন করে ট্র্যাক পাতার ক্ষেত্রে বরাদ্দ রাখা হয়নি। আবার যে টাকা বরাদ্দ হয়েছে তাও পুরোপুরি খরচ করা হয়নি। রাষ্ট্রীয় রেল সুরক্ষা কোষের নির্দেশিকা থাকা সত্ত্বেও রেলে ‘নন প্রায়োরিটি টাস্কে’ খরচ করার প্রবণতা বেড়েছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, নতুন করে ট্র্যাক পাতার খাতে বরাদ্দ ক্রমেই কমেছে। ২০১৮-১৯ অর্থবর্ষে বরাদ্দ ছিল ৯,৬০৭.৬৫ কোটি টাকা। সেখানে পরের বছরের বরাদ্দ হয় ৭,৪১৭ কোটি টাকা। একই সঙ্গে রেল লাইন পরিদর্শন এবং সুরক্ষার জন্য যত সংখ্যক কর্মী রাখার কথা তা রাখা হয়নি। সব শেষে ক্যাগ রেলকে ট্র্যাক ও সিগন্যাল ব্যবস্থা পরিদর্শনে বাড়তি গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শও দিয়েছিল। এখন প্রশ্ন উঠছে, সেই পরমর্শকে গুরুত্ব না দেওয়ার জন্যই এত বড় ক্ষতি হয়ে গেল?