মিলেমিশে: মন্দিরের চাতালে দত্তপুকুরের নাকশার বাসিন্দারা। নিজস্ব চিত্র
তখন অনেক রাত। প্রথমে শ্বাসকষ্ট, তার পরে দু’হাতে বুক চেপে বিছানায় ছটফট করছিলেন বছর চল্লিশের কাশী দাস। বাইরে তখন জ্বলছে অশান্তির আগুন। তার মধ্যেই গিয়ে অ্যাম্বুল্যান্স ডেকে আনেন নুরুল। পাঁজাকোলা করে কাশীকে বারাসত হাসপাতালে নিয়ে যান কামাল, সেলিম-রা। চিকিৎসক দেখে বলেন, আর একটু দেরি হলেই...।
সম্প্রতি দত্তপুকুরের নাকশার ‘সতীমাতা মায়ের’ মন্দির-চাতালে বসে সে কথাই শোনাচ্ছিলেন আমিনউদ্দিন মোল্লা। বাপ-ঠাকুরদার আমল তো বটেই, তারও কত আগে থেকে কাশী-নুরুল-আমিনউদ্দিনরা এই নাকশায় প্রতিবেশী, হিসেব করে বলতে পারেন না কেউই। নয়া নাগরিকত্ব আইন নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবে তার বিরোধিতার ধরন যে হিংসাত্মক হওয়া উচিত নয়, সে ব্যাপারে একমত সকলেই।
নতুন আইনের বিরোধিতায় যখন উত্তাল উত্তর ২৪ পরগনা তথা গোটা রাজ্য, তখন হাতে হাত রেখে কাশী, আমিনউদ্দিনরা প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, ‘সরকারি সম্পত্তি আদতে আমাদেরই সম্পত্তি। সে সব নষ্ট করে বিরোধিতা আমরা কখনও করব না।’ নুরুল ইসলামের কথায়, ‘‘ঘণ্টার পর ঘণ্টা অবরোধে আটকে কেউ হাসপাতালে যেতে পারবেন না, বাড়ি ফিরতে না পেরে ছেলেমেয়েরা রাস্তায় বসে থাকবে, আগুনে পুড়বে কারও গাড়ি, কারও দোকান— এ সব আমরা করতে পারব না। করতে দেবও না।’’
বর্তমান পরিস্থিতিতে আরও শক্ত হয়ে এ ভাবেই যে জোট বাঁধতে হবে, তা নিয়ে আলোচনায় বসেছিলেন ওঁরা। দু’পাশে বসা দুই প্রতিবেশীকে দেখিয়ে তুহিন মোল্লা বললেন, ‘‘বছরের পর বছর আমরা একসঙ্গে রয়েছি। এখন কেউ যদি বলে নুরুল, রঞ্জিতকে ছেড়ে চলে যেতে হবে, মেনে নেওয়া যায়?’’ চোয়াল শক্ত করে মাথা নাড়েন সকলে, ‘কখনওই নয়।’
মুসলিম অধ্যুষিত নাকশার বিশেষত্ব এখানেই, বলছিলেন জেলা প্রশাসনের এক কর্তা। এখানে দুই সম্প্রদায়ের মানুষ কাঁধ মিলিয়ে মন্দির তৈরি করেছেন। মন্দিরের এক প্রতিষ্ঠাতা স্বপন সাধক বলেন, ‘‘বছরখানেক আগে মন্দিরের উদ্বোধন করেন মহম্মদ আলি। মন্দির তৈরির সময়ে ঢালাইয়ের জন্য একটা পয়সাও নেননি তিনি। আলি ভাইয়ের কিছু হলে আমি আগে ছুটে যাই। ক’দিন আগে আমার মেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। ওকে নার্সিংহোম নিয়ে যান আলি ভাইরাই।’’
তুহিনের কথায়, ‘‘আমরা চাষবাস করি। ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করে। কারও বাড়ি গল্প করতে যাই, কেউ অসুস্থ হলে সবাই ছুটি। জাতপাত নিয়ে ভাবার সময় কোথায়?’’ এ সব আলোচনার মধ্যেই কামাল হাসান বলে ওঠেন, ‘‘এই ধরনের পরিস্থিতি আসলে আমাদের পরীক্ষা নেয়। তাই আমাদের বাপ-ঠাকুর্দার ধরে রাখা ঐক্য কিছুতেই ভাঙতে দেওয়া যাবে না।’’
নাকশার ওই মন্দিরের পূজারী গোপাল চক্রবর্তী বললেন, ‘‘ঠাকুরদার আমল থেকে দেখছি, আমার বাবা-মা আর কামাল, ইরাদের বাবা-মা একসঙ্গে যাত্রা দেখতে যেতেন। ইদ-দুর্গাপুজোয় একে অন্যকে নতুন পোশাক দেন। আজ এই ধরনের ছোটখাটো সমস্যা আমাদের আলাদা করে দেবে, এত সহজ?’’
এলাকার পঞ্চায়েত সদস্য রঞ্জিত দাসের ছেলেবেলার বন্ধু কামাল। রঞ্জিত বলেন, ‘‘কী চায়? বন্ধুকেও আলাদা করে দেবে!’’ এ বার কামাল বলে ওঠেন, ‘‘পারবে না। সব সময়ে সঙ্গে থাকব। এই বিশ্বাসটা রাখলেই হবে।’’
‘আমরা হলাম হরিহর আত্মা। আমাদের আলাদা করে কার সাধ্যি?’ এই প্রথম হেসে ওঠেন সকলে।