ক্ষোভাগ্নি: পৃথক রাজ্যের দাবিতে জনজাতি আন্দোলন, কার্বি আংলং, ৬ অগস্ট ২০১৩
মাসখানেক আগে ঘুরে এলাম অসমের ষষ্ঠ তফসিলে অন্তর্ভুক্ত দু’টি স্বশাসিত পরিষদ। একটি কার্বি আংলং স্বশাসিত পরিষদ, অন্যটি ডিমা হাসাও স্বশাসিত পরিষদ। দু’টি স্বশাসিত পরিষদের সদর ডিফু ও হাফলং। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে ডিফু ট্রেনে প্রায় ১২ ঘণ্টার পথ। সেখান থেকে ট্রেনে ৩ ঘণ্টার পথ হাফলং। দু’টি শহরই ছোট পাহাড়ের উপরে। এখান থেকে নাগাল্যান্ড, মণিপুর খুব দূরে নয়। দু’টি পার্বত্য এলাকাতেই ঘন বনাঞ্চল।
সংবিধানের ২৪৪(২) এবং ২৭৫(১) ধারা অনুযায়ী অসম, মেঘালয়, মিজ়োরাম, ত্রিপুরার জনজাতি অধ্যুষিত এলাকায় স্বশাসিত জেলা পরিষদ অথবা আঞ্চলিক পরিষদ গঠনের ব্যবস্থা রয়েছে। ষষ্ঠ তফসিলে অন্তর্ভুক্ত এ রকম স্বশাসিত ও স্বায়ত্তশাসিত পরিষদ রয়েছে মোট দশটি: অসমে ৩টি, মেঘালয়ে ৩টি, মিজ়োরামে ৩টি এবং ত্রিপুরায় ১টি। এই দশটি স্বশাসিত পরিষদের মধ্যে নয়টি এলাকা ব্রিটিশ শাসনকালে ছিল ব্যাকওয়ার্ড ট্র্যাক হিসেবে পরিচিত। পরে এই এলাকাগুলির নতুন নাম হয়, কখনও শিডিউল জেলা, কখনও অটোনমাস জেলা, কখনও বা এক্সক্লুডেড এরিয়া বা পার্শিয়ালি এক্সক্লুডেড এরিয়া।
১৯৫১ সালে মিকির পার্বত্য এলাকা এবং উত্তর কাছাড় পার্বত্য এলাকার জন্য দু’টি পৃথক স্বশাসিত জেলা গঠন করা হয়। স্বাধীন ভারতে এই ছিল প্রথম নির্বাচন। তখন এই দু’টি স্বশাসিত পরিষদ এলাকা ছিল সংযুক্ত মিকির পার্বত্য ও উত্তর কাছাড়় পার্বত্য জেলায়। এর পর মিকির পার্বত্য জেলার নতুন নামকরণ হয় কার্বি আংলং জেলা, এবং উত্তর কাছাড় জেলার নাম হয় ডিমা হাসাও জেলা। বেশ কয়েক বছর আগে কার্বি আংলং জেলা ভেঙে নতুন আর একটি জেলা গঠিত হয়, পশ্চিম কার্বি আংলং। বর্তমানে কার্বি আংলং স্বশাসিত পরিষদের সদর ডিফু শহর, ডিমা হাসাও স্বশাসিত পরিষদের সদর হাফলং শহর। এই দু’টি স্বশাসিত জেলা পরিষদ এলাকা মূলত কার্বি এবং ডিমাসা জনজাতির ভূমি হলেও কাছাড়ি, নাগা, কুকি, তিওয়া, রাংখেল জনজাতির মানুষরাও বসবাস করেন, করেন বহু বাঙালি, নেপালি ও হিন্দিভাষী মানুষও। এই দু’টি স্বশাসিত পরিষদই ভারতের ষষ্ঠ তফসিলে অন্তর্ভুক্ত প্রথম স্বশাসিত পরিষদ, যা গঠিত হয় ১৯৫১-য়। ১৯৬১-তে নাগা শিডিউল জেলাটি পৃথক নাগাল্যান্ড রাজ্যে পরিণত হয়। মেঘালয়কেও প্রথমে স্বশাসিত রাজ্য, পরে পূর্ণ রাজ্য করা হয়। লুসাই পাহাড় পরিণত হয় পৃথক পূর্ণ রাজ্য মিজ়োরামে। ত্রিপুরা ও মণিপুরকেও পূর্ণ রাজ্যে পরিণত করা হয়। রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন এনইএফএ-কে পরিণত করা হয় অরুণাচল প্রদেশে। অন্য রাজ্যগুলির মতো ১৯৮২ সালে ত্রিপুরাতেও হয় জনজাতি গোষ্ঠীর জন্য স্বশাসিত জেলা পরিষদ। ২০০৩ সালে সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিল সংশোধন করে বোড়োল্যান্ড টেরিটোরিয়াল কাউন্সিল গঠিত হয়।
উল্লেখ্য, অবিভক্ত অসমের পার্বত্য জনজাতি এলাকাগুলি নামেই ছিল ব্রিটিশশাসিত, ব্রিটিশ আমলে এই অঞ্চলকে বলা হতো ‘নন-রেগুলেটরি’ বা রাষ্ট্রহীন অঞ্চল। ব্রিটিশ শাসকরা এই অঞ্চলের জনজাতিদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যুদ্ধের পর তাঁরা দেবেন পৃথক সার্বভৌম রাষ্ট্র। পরিবর্তে তাঁরা যেন কোনও অবস্থাতেই ব্রিটিশের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অংশগ্রহণ না করেন। যাতে সমতলবাসীদের সঙ্গে পাহাড়বাসীদের সুসম্পর্ক গড়ে না উঠতে পারে, সেই উদ্দেশ্যেই ব্রিটিশ রাজ চালু করেছিল ‘ইনার লাইন পারমিট’ ব্যবস্থা।
বরদলৈ কমিটি গণপরিষদে যে রিপোর্ট জমা দিয়েছিল, তার মূল বিষয় ছিল পার্বত্য জনজাতিদের পরম্পরা, সামাজিক রীতি, সম্পত্তি বা বিবাহ সম্পর্কে যে নিজস্ব রীতি, গ্রামীণ শাসন পদ্ধতি যা দীর্ঘকাল ধরে বজায় রয়েছে তার সম্পূর্ণ সুরক্ষা দেওয়া হবে ষষ্ঠ তফসিলে। শুধু তা-ই নয়, এই সমস্ত অঞ্চলে কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারের কোনও আইন প্রযোজ্য না-ও হতে পারে। স্বশাসিত পরিষদগুলির হাতে দেওয়া হল বিশেষ বিচারবিভাগীয় ব্যবস্থা, এমনকি আইন বা বিধি প্রস্তুত করার ক্ষমতাও। কার্বি আংলং ও ডিমা হাসাও স্বশাসিত পরিষদ ভ্রমণ করার আমাদের উদ্দেশ্য ছিল এই দু’টি স্বশাসিত পরিষদের বর্তমান কার্যকলাপ সম্পর্কে অবগত হওয়া এবং এই এলাকার জনজাতি মানুষদের কাছ থেকে কিছু ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করা। উত্তর-পূর্ব ভারতের অন্য স্বশাসিত পরিষদগুলি অবশ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আরও পরে। ইতিমধ্যে এ সমস্ত এলাকায় পৃথক রাজ্যের দাবিতে হিংসাশ্রয়ী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। তবে পরবর্তী কালে এই জনজাতিগুলিকে স্বশাসন দেওয়ার ফলে আজ তাঁরা দেশের মূলস্রোতে অনেকটা ফিরে এসেছেন।
মনে রাখতে হবে, উত্তর-পূর্ব ভারতে শুধু প্রাকৃতিক, বনজ বৈচিত্র নয়, ওই অঞ্চলে রয়েছে নানা প্রশাসনিক বৈচিত্রও। যা ভারতের অন্য কোনও স্থানে নেই। এই সমস্ত পার্বত্য অঞ্চলে ৯০ শতাংশ মানুষই জনজাতি, যা ভারতের অন্য কোনও অঞ্চলে নেই। স্বশাসিত পরিষদগুলোর মধ্যে দিয়ে জনজাতিদের সাংস্কৃতিক এবং আর্থ-সামাজিক পরিচিতির সংরক্ষণ এবং উন্নয়নকে অনেকটা অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হয়েছে। তেমনই তাঁদের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, আর্থিক বা প্রশাসনিক সীমাবদ্ধতার চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হচ্ছে, তার সমাধানও খুঁজতে হচ্ছে। যেমন, রাজ্যপালের নিজের ইচ্ছামতো ক্ষমতা প্রয়োগ করার অধিকার, আইন সংশোধন করে নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারেরও কোনও স্বশাসিত পরিষদের ক্ষেত্রে কোনও পদক্ষেপ করার পূর্বে পরিষদের সঙ্গে পরামর্শ করা বাধ্যতামূলক। রাজ্য অর্থ কমিশনের আদলে এই স্বশাসিত পরিষদগুলির মধ্যেই পৃথক অর্থ কমিশন গঠন করা হচ্ছে।
বর্তমানে এই দু’টি স্বশাসিত পরিষদই নির্বাচনে জয়ী হয়ে পরিচালনা করছে বিজেপি। ১৯৮৯ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত কার্বি আংলং স্বশাসিত পরিষদ পরিচালনা করেছিল এএসডিসি, যেখানে সিপিআই(এমএল) ছিল প্রধান দল। তাদের নেতা জয়ন্ত রংপি পর পর তিন বার ওই এলাকা থেকে লোকসভায় সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন। অনেকেই ভাবেন, এই অঞ্চলে বিজেপির রাজনৈতিক ভাবে মাথাচাড়া দেওয়ার মূল কারণ হিন্দুত্বের রাজনীতি নয়। বাস্তবিক, হিন্দুত্বের প্রভাব উত্তর-পূর্ব ভারতে পার্বত্য এলাকায় অনেক কম। আসল সঙ্কট তৈরি হয়, শাসনক্ষমতার অপব্যবহার করে বিভিন্ন দল থেকে রাজনীতিকদের দলত্যাগ করানোর ফলে। অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত পরিচয়-সহ এই সমস্ত স্বশাসিত জেলা পরিষদগুলি বিকেন্দ্রীভূত শাসনের ব্যতিক্রমী উদাহরণ হিসেবে কাজ করছে। ঐতিহাসিক ভাবে প্রান্তিকতা, এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিচ্ছিন্নতা সহ্য করেও পরিষদগুলি সুশাসন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য যেখানেই উদ্যোগ করেছে, সেইখানে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন ও জনজাতি সমাজের জন্য কিছু অবদান রাখতে পেরেছে।
এ প্রসঙ্গেই আসতে পারি দার্জিলিং জেলার পার্বত্য এলাকায় রাজ্যের আইনে ১৯৮৮ সালের দার্জিলিং গোর্খা হিল কাউন্সিল (ডিজিএইচসি) এবং ২০১১ সালে গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (জিটিএ)-এর কথায়। এই দু’টি ক্ষেত্রেই ষষ্ঠ তফসিলের মতো কোনও অটোনমাস বা স্বশাসিত পরিষদ নেই। নেই আইন তৈরি করার বা বিচারবিভাগীয় ক্ষমতা। ২০০৫ সালে ডিজিএইচসি-র তৎকালীন প্রশাসক সুভাষ ঘিসিং রাজ্য সরকারের কাছে দাবি করেন সাংবিধানিক স্বীকৃতি-সহ স্বশাসিত পরিষদ। ২০০৬ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় এই প্রস্তাবের পক্ষে সিদ্ধান্ত হয়। স্বাক্ষরিত চুক্তির ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় সরকার সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিল এবং ২৪৪(২) ও ২৭৫(১) ধারাগুলি সংশোধনীর সাহায্যে রাজ্যের মধ্যে গোর্খা হিল কাউন্সিল এলাকা কথাটি যুক্ত করে সংবিধানের ১০৭তম সংশোধনী সংসদে উত্থাপন করা হয়। পরে অবশ্য বিলটি পাঠানো হয় সংসদের স্ট্যান্ডিং কমিটিতে। বিভিন্ন সাংসদ, প্রাক্তন সাংসদ, বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্যদের সঙ্গে মতবিনিময় করার পর রাজ্য বিধানসভার ১৮ জনের প্রতিনিধি দল স্ট্যান্ডিং কমিটির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সকলেই মনে করেন, দার্জিলিং পার্বত্য এলাকার রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান সম্ভব একমাত্র গোর্খা পার্বত্য পরিষদ গঠনের মাধ্যমে।
দার্জিলিং পাহাড়ের অধিকাংশ মানুষের মধ্যে কিছু বৈশিষ্ট্যের কারণে পৃথক রাজ্যের একটি আবেগ আছে, অস্বীকার করা যায় না। এই আবেগের প্রতি এতটুকু অশ্রদ্ধা ও অসম্মান না করেও বলতে ইচ্ছে করে, রাজ্যের মধ্যে ষষ্ঠ তফসিলে অন্তর্ভুক্ত স্বশাসিত পরিষদই হয়তো দার্জিলিং পার্বত্য এলাকার সমস্যার বাস্তবসম্মত সমাধানের পথ। কার্বি আংলং এবং ডিমা হাসাও-এর অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয়, এই পথেই রাজনৈতিক স্থিতির সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।