Coronavirus Lockdown

ভোট মিটলেই কি রাজ্যে আবার লকডাউন? উদ্বেগে ব্যবসায়ী মহল

কোভিডের ক্রমশ বিগড়োতে থাকা পরিস্থিতি আর মৃত্যু-মিছিল দেখে ব্যবসায়ী মহলের একটা বড় অংশের আশঙ্কা, ফের কারবারে তালা না পড়ে!

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০২১ ০৬:৪৮
Share:

ফাইল চিত্র।

‘ভোট মিটলেই ফের লকডাউন হবে না তো?’— গরমের ঘেমো দুপুরে চশমার উপর দিয়ে তাকিয়ে প্রথমেই প্রশ্নটা ছুড়লেন বড়বাজারের এক ব্যবসায়ী। গলায় এক রাশ উৎকণ্ঠা।

Advertisement

পদ্ম বনাম জোড়াফুলের টক্কর, ইভিএমের পেটে সেঁধিয়ে থাকা রাজ্যের রাজনৈতিক ভাগ্য, ২ মে জেতা-হারার সম্ভাবনা ঘিরে আড্ডা আর তর্ক— সব আছে। কিন্তু কোভিডের ক্রমশ বিগড়োতে থাকা পরিস্থিতি আর মৃত্যু-মিছিল দেখে ওই সব কিছুর আগে এখন ব্যবসায়ী মহলের একটা বড় অংশের আশঙ্কা, ‘ফের কারবারে তালা না-পড়ে!’

রাজরোষ এড়াতে অধিকাংশ জনই নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক। কিন্তু সামান্য খোঁচাতেই বেরিয়ে আসছে ক্ষোভ। মোদ্দা কথা, তড়িঘড়ি চালুর পরে অসংখ্য বার নিয়ম বদলানো পণ্য-পরিষেবা কর (জিএসটি) ঝামেলায় ফেলেছে বহু ছোট ব্যবসায়ীকে। সময়ে রিটার্ন দাখিলের ঝক্কি সামলাতে গিয়ে ব্যবসার চিন্তা-ভাবনা লাটে ওঠার জোগাড়। কোমর ভেঙে দিয়ে গিয়েছে নোটবন্দি। আর এই সমস্ত কিছুর ঊর্ধ্বে কার্যত কফিনে শেষ পেরেক পোঁতার দশা করেছিল লকডাউন।
কনফেডারেশন অব ওয়েস্ট বেঙ্গল ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট ফিরোজ আলির কথায়, ‘‘ব্যবসায়ীদের একাংশের কাছে নরেন্দ্র মোদী এখনও কার্যত উপরওয়ালার মতো। তাঁর উপরে অগাধ আস্থা। কিন্তু তেমনই তাঁর এবং তাঁর দলের দেওয়া বহু প্রতিশ্রুতি যে মিথ্যা, তা বুঝতে পারছেন কেউ কেউ।’’ নাম
না বলেও একই মতের শরিক আরও অনেকে।

Advertisement

তবে কি ক্যাশ-বাক্সের ঝনঝনানি কমার কারণে বিজেপির প্রতি সমর্থনে ধস নামল ছোট ব্যবসায়ীদের? সাধারণত এ রাজ্যে যাঁদের একটি বড় অংশ (বিশেষত অবাঙালি) বিজেপির পোক্ত ভোট-ব্যাঙ্ক বলে পরিচিত!

পাল্টা যুক্তি আর রাস্তার পাশের হনুমান মন্দিরের ঘণ্টা মনে করিয়ে দেয়, রাজনীতির অঙ্ক অত সহজ নয়। ভেসে আসে ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য, ‘এ রাজ্যে অবাঙালি ব্যবসায়ীদের বড় অংশের শিকড় রাজস্থান আর গুজরাতে। বিজেপির প্রতি তাঁদের দুর্বলতা নতুন নয়।’ কেউ বলছেন, ‘শুধু তো ব্যবসার টাকা গুনে কেউ ভোট দেন না। তার মধ্যে ঢুকে পড়ে জাতপাত, ধর্ম আর ভাষার জটিল অঙ্ক।’ ইঙ্গিত স্পষ্ট, সেই সমীকরণে অনেকের কাছে ‘অ্যাডভান্টেজ বিজেপি’। তেমনই বাম জমানাকে দুষে কেউ আবার বলছেন, ‘ব্যবসায়ী মানেই ধান্দাবাজ, তৃণমূলের সময়ে অন্তত এই তকমা অনেকটা মুছেছে। আপদে-বিপদে পাশে থাকার চেষ্টা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী।’ তবে কি...? প্রশ্ন শেষ না-হতেই অপ্রস্তুত হাসি সমেত উত্তর আসে, ‘আমরা ছোট ব্যবসায়ী। শান্তিতে ব্যবসাটুকু করতে পারলেই খুশি। দোহাই, এ সবে টানবেন না।’

বস্ত্র ব্যবসায়ী গৌতম ঝুনঝুনওয়ালা অবশ্য খোলাখুলি বলছেন, ‘‘দশ বছরের প্রতিষ্ঠান-বিরোধী জোরালো হাওয়া আছে। রাজ্য সরকারের বহু ভাল প্রকল্প ঠিক ভাবে কার্যকর হওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তৃণমূলের ব্যক্তি নির্ভরতা। সে নিয়ে ক্ষোভ যথেষ্ট।’’ তবে দীর্ঘ মেয়াদে জিএসটিতে ছোট ব্যবসায়ীদের সুবিধা হবে বলেও তাঁর দাবি।

এক ব্যবসায়ী আবার বলছেন, ‘‘এ রাজ্যে ১০ কোটিরও বেশি লোকের বাস। কিন্তু সেই অনুপাতে বিক্রিবাটা কই? কারণ, বহু দিন এখানে বড় শিল্প নেই, নেই লগ্নি। বড় কল-কারখানা-ব্যবসা রাজ্যে না এলে, চাকরি হবে কোথা থেকে? আর মানুষের হাতে টাকাই যদি বেশি না থাকে, কার কাছে জিনিস বেচবেন ব্যবসায়ীরা?’’

এই ব্যবসায়ীদের কারও ব্যবসা বড়বাজারে, কারও শহরের অন্যত্র। কিন্তু একটি ক্ষোভ সবার মুখে-মুখে। তা হল, ‘কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকার বড় শিল্পের কথা ভাবে। বড় ব্যবসাকে গুরুত্ব দেয়। কিন্তু মুখে বললেও, ছোট ব্যবসায়ীদের দুর্দশা নিয়ে মাথাব্যথা নেই দুই সরকারেরই। পরিস্থিতি এমনই যে, এখন জমানো পুঁজি ভেঙে কোনওক্রমে ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে হচ্ছে অনেককে। সেই জোর না-থাকায় ঝাঁপ বন্ধ করতেও বাধ্য হচ্ছে বহু দোকান।’ বস্ত্র ব্যবসায়ী বীরেন্দ্র আগরওয়ালের মতে, ‘‘সবার আগে জিএসটির নিয়ম সরল করুক কেন্দ্র।’’ বণিকসভা মার্চেন্টস চেম্বার অব কমার্সের ভাইস প্রেসিডেন্ট রিশভ কোঠারির কথায়, ‘‘নব্বইয়ের দশকের সংস্কারের সুফল সিংহভাগ ঘরে তুলেছে বড় সংস্থাগুলি। ছোট ব্যবসায়ীদের সুরাহা দিতে ফের এক দফা সাহসী সংস্কার প্রয়োজন। আর সেই সঙ্গে জরুরি লাল ফিতের ফাঁস আলগা হওয়া।’’

মনের কোণে জমে থাকা ক্ষোভের রকম-সকমও বিভিন্ন। কেউ বলছেন, ‘বেওসা’ করা মানেই সে খারাপ লোক নয়। আবার কারও প্রশ্ন, ‘তিন পুরুষ বাংলায় কাটানোর পরেও কি বহিরাগত তকমা প্রাপ্য হিন্দিভাষীর?’ কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী তো নিজেই বলেছেন, হিন্দিভাষী মানেই বিজেপি সমর্থক নয়! তা হলে? মুচকি হেসে এক হিন্দিভাষী দোকানির উত্তর, ‘‘হিন্দিতে কথা, নিরামিষ খাবার, রাম-সীতার ভজন আর হনুমান চল্লিশা— ভোট যাকেই দিই, বিজেপি সমর্থকের ছাপ আমাদের গায়ে সেঁটে দেওয়া হয় আগে থেকেই।’’

হিসেবে পাকা, রুক্ষ ব্যবসায়ী-মনের মধ্যে থেকেও অবশ্য মাঝেমধ্যে উঁকি দিচ্ছে মেরুকরণ আর জাতীয়তাবাদের ফল্গু। অযোধ্যায় রামমন্দির উদ্বোধনের পরে সপরিবার যাওয়ার কথা এখন থেকেই ঠিক করে রেখেছেন কেউ কেউ। অনেকে খুশি কাশ্মীরকে ঠান্ডা করার ‘হিম্মতে’। কেউ খোলাখুলি বলছেন, ‘কোভিড সামলাতে ভুল-ত্রুটি হতে পারে। কিন্তু পাকিস্তানকে মুখের উপর জবাব দিতে মোদীজির জুড়ি নেই।’ কেউ আবার তেমনই পাল্টা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ‘ব্যবসা টিকলে তবে না অযোধ্যা যাওয়া!’

কোভিড পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। লকডাউন প্রসঙ্গে উৎকণ্ঠা আছে। ব্যবসার ধুঁকতে থাকা হাল নিয়ে অভিযোগ আছে। কিন্তু ইভিএমে আঙুল কোন বোতামে, তা নিয়ে সিংহভাগের মুখে টুঁ-শব্দটি নেই।

সেই উত্তর নোটবন্দিতে ভোগা ব্যবসায়ী মহলের মনের মধ্যেই আপাতত তালাবন্দি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement