বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। —ফাইল ছবি।
এক বার ঘরোয়া আড্ডায় উত্তর কলকাতা এবং দক্ষিণ কলকাতার মধ্যে খুনসুটি চলছিল। উপস্থিত বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তখনও তিনি মুখ্যমন্ত্রী হননি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও ছিলেন সেখানে। বুদ্ধদেব হাসতে হাসতে বলেছিলেন, “ভাগ করতে চাইছি না। তবে আসলে আমি নর্দার্ন।”
উত্তর কলকাতার শ্যামপুকুরে ১১ডি, রামধন মিত্র লেনের বাড়িটির পরিচিতিতে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য নামটি এখন অবশ্যই অন্যতম স্মারক। বুদ্ধবাবুর শিকড় সন্ধান করতে গেলে তাঁর এই পৈতৃক ঠিকানায় তো থামতেই হবে। আর পাঁচটি বড় একান্নবর্তী পরিবারের মতো এখানেও সদস্যেরা কালক্রমে ছড়িয়ে গিয়েছেন এ-দিক ও-দিক। বুদ্ধদেব নিজেও।
তবু এটাই তাঁর বাড়ি, তাঁর পাড়া। তাঁর জীবনের প্রথম সবকিছু জানে এই শ্যামপুকুর। এখানে তিনি বাচ্চু। তাঁর স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, বন্ধু, আড্ডা, খেলা, নাটক, অ্যাডভেঞ্চার, দুষ্টুমি সব কিছুর ‘কমপ্লিট প্যাকেজ’ শ্যামপুকুরের বাতাসে ছড়িয়ে রেখে গিয়েছেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। এখন তাঁকে ডাকনামে ‘বাচ্চু’ বলার মতো লোক পাড়ায় ক’জন আছেন, কে জানে!
শ্যামপুকুরের এই বাড়িতেই থেকেছেন তাঁর পিতামহ, ‘পুরোহিত দর্পণ’-এর প্রণেতা পণ্ডিত কৃষ্ণচন্দ্র স্মৃতিতীর্থ। বুদ্ধদেবের বাবার খুড়তুতো ভাই কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যও তাঁর স্বল্প-জীবনের অনেকটা কাটিয়েছিলেন এই বাড়িতে। যদিও বুদ্ধদেব তাঁকে জ্ঞানত দেখেননি। শুনেছেন তাঁর কথা।
বাচ্চুর লেখাপড়া শুরু পাড়ার শৈলেন্দ্র সরকার স্কুলে। ক্রিকেট, সাঁতার, নাটক, স্কুলে নেভি-র প্রশিক্ষণ সব কিছু উত্তর কলকাতার এই স্কুল, এই এলাকা এবং এই বাড়িকে ঘিরে। তাঁর ছেলেবেলার বন্ধুদের কাছে শুনেছি, দেশবন্ধু পার্ক, টালা পার্ক থেকে শুরু করে পাড়ায় নবকৃষ্ণ স্ট্রিটে ‘বুলার মাঠ’ (বন্ধু অলক ওরফে বুলার বাড়ির সামনে) পর্যন্ত সর্বত্র ক্রিকেট খেলে বেড়াতেন বুদ্ধ। ভাল ব্যাট করতেন। স্কুল টিমে খেলেছেন অম্বর রায়ের সঙ্গে। অল্পস্বল্প ক্রিকেট শিখেছেন কার্তিক বসুর কাছে।
ক্লাস সেভেন-এইট থেকেই ধুতি-পাঞ্জাবি পরতে অভ্যস্ত ছিলেন শ্যামপুকুরের বাচ্চু। এমনকি, অনেক দিন স্কুলেও যেতেন ধুতি পরে। ‘ব্রিজ’ খেলার নেশা ধরেছিল হায়ার সেকেন্ডারির পরে। শোভাবাজারের গুড়পট্টিতে এক বন্ধুর বাড়িতে জমত সেই তাসের আড্ডা। মাঝে মাঝে তাসের প্যাকেট নিয়ে বন্ধুরা দল বেঁধে চলে যেতেন উল্টোডাঙার খালের ও-পারে। সল্টলেক তখন দূর অস্ত। বালির উপর বসেই খেলা চলত।
স্কুলে পড়ার সময় বাড়ির ছাদে মা-কাকিমাদের শাড়ি দিয়ে পর্দা খাটিয়ে ভাইবোনেদের নিয়ে অভিনয়ও করেছেন সরস্বতী পুজো বা রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষে। আবার শ্যামপুকুরেই প্রতিবেশী দাদা গৌর ভদ্রের পরিচালনায় বুদ্ধবাবুর লেখা নাটক মঞ্চস্থ হয়। তার একটি ক্লিফোর্ড ওডেটসের ‘লেফটি’ অবলম্বনে ‘বিজয়ের অপেক্ষায়’, অন্যটি সার্ত্রের ‘মেন উইদাউট শ্যাডো’-র অনুসরণে ‘ছায়াবিহীন’।
স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর রাজনীতিরও শুরু শ্যামপুকুরে। প্রাথমিক ভাবে দুই জামাইবাবু সিপিআই নেতা জ্যোতিপ্রকাশ চট্টোপাধ্যায় ও দীপক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কিছুটা প্রভাব পড়েছিল। তবে পরে অলক মজুমদার, দীনেশ মজুমদারের সঙ্গে যোগাযোগ তাঁকে সিপিএমের দিকে নিয়ে যায়। পাড়ার পুরনোরা অনেকে দেখেছেন, বুদ্ধদেবের বাড়ির দরজার সামনে বেঞ্চে বসে থাকতেন দীনেশ মজুমদার। কেউ প্রশ্ন করলে বলতেন, “বুদ্ধের লগে দেখা করতে আইসি।”
কারও পরিবারের অন্দরমহলে উঁকি দেওয়া শোভন নয়। তবু ধরে নেওয়া যায়, পারিবারিক কারণেই বুদ্ধবাবুদের শ্যামপুকুর ছাড়তে হয়। ১৯৬৭। তখন তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে। জেল এড়াতে লুকিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। মা-বাবার সঙ্গে গেলেন না বটে, তবে ঠিকানা বদলাল পামারবাজারে। সেখান থেকে এন্টালির হরলাল পাল স্ট্রিট, তার পরে ট্যাংরার আবাসন এবং শেষ ঠিকানা পাম অ্যাভিনিউ।
ঠাঁই বদল হলেও বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি। তাঁর স্কুলের শিক্ষক জ্যোতির্বিকাশ মিত্রের মূর্তিস্থাপন অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব। পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে কথায় বলেন, “আমরা কি বছরে এক দিন একসঙ্গে বসতে পারি না?” কেউ কেউ বললেন, “তুই কি পারবি?” কথা দিয়েছিলেন, পারবেন। সেই থেকে অনেক বার পুজোয় এক দিন কারও বাড়িতে আড্ডা হত। মুখ্যমন্ত্রী নয়, বন্ধু বুদ্ধদেব পা তুলে গুছিয়ে বসতেন আড্ডায়।
সেখানেই এক বার এক বন্ধু বলেছিলেন, “তোর চারপাশের লোকেরা খুব গোলমেলে। তোকে নিয়ে সব সময় সত্যি বলে বলেও মনে হয় না!” শান্ত ভাবে জবাব দিয়েছিলেন, “কী করব বল! এটা সিস্টেমের দোষ। আমিও চেনার চেষ্টা করছি।” আবৃত্তি করেছিলেন তাঁর প্রিয় পঙ্ক্তি, “আমার পাতালমুখী বসুধার ভার জানি কেহ পারিবে না ভাগ করে নিতে....”।
পুজোর মজলিশ বন্ধ হয়ে যায় বহু দিন আগে। বন্ধুরাও অনেকে নেই। যাঁরা আছেন, স্মৃতিভার তাঁদের সম্বল।