কমিশনের বিরুদ্ধে বাহিনী মোতায়েন পরিকল্পনা নিয়ে অভিযোগ তুলল বিএসএফ। —ফাইল চিত্র।
চেয়েও পাওয়া যায়নি সংবেদনশীল বুথের তালিকা— ভোট মিটতেই রাজ্য নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে সরাসরি এই অভিযোগ তুলল বিএসএফ বা সীমান্তরক্ষী বাহিনী। খুব শীঘ্রই বাহিনী ও কমিশনের এই দ্বৈরথ আদালতে গড়াতে পারে বলে মনে করছেন প্রশাসনিক পর্যবেক্ষকেরা।
অভিযোগ, ভোট লুট, হিংসা, সন্ত্রাস, রক্তপাত, প্রাণহানি — কিছুই বাকি ছিল না শনিবারের রাজ্যের দশম পঞ্চায়েত ভোটকে কেন্দ্র করে। যা ভোট-নিরাপত্তা নিয়ে বড়সড় প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। দায় কার— সেই প্রশ্নের নিরিখে কার্যত কাঠগড়ায় রাজ্য নির্বাচন কমিশন। এই অবস্থায় ভোট মিটতেই কমিশনের বিরুদ্ধে বাহিনী মোতায়েন পরিকল্পনা নিয়ে খোলাখুলি অভিযোগ তুলল বিএসএফ। বাহিনীর বক্তব্য, প্রথা মেনে মোতায়েনের আগে যে তথ্য দেওয়ার কথা ছিল কমিশনের, তা শেষ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তথ্য দেওয়ার যে দাবি কমিশন করে আসছিল, তা-ও কার্যত খারিজ হয়েছে বাহিনী-কর্তার বক্তব্যে।
প্রশাসনিক পর্যবেক্ষকেরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ভোট নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাহিনী মোতায়েনকে হালকা ভাবে না নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল কলকাতা হাই কোর্ট। তার পরেও শনিবার রাজ্য জুড়ে কার্যত ঢিলেঢালা নিরাপত্তা এবং কেন্দ্রীয় বাহিনীর উপস্থিতি সে-ভাবে চোখে না পড়ায় ফের আইনের দ্বারস্থ হওয়ার পথে সংগ্রামী যৌথ মঞ্চ এবং রাজ্য কর্মচারী পরিষদ-সহ অনেকে। আজ, সোমবার আদালতে মামলা দায়ের হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে সূত্রের দাবি। সেই অবস্থায় কমিশনের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় বাহিনীর অভিযোগকে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। তার পাশাপাশি এ প্রশ্নও উঠছে, ভোটের পরে যে অভিযোগে সরব হয়েছেন বাহিনী কর্তৃপক্ষ, ভোটের আগে তাঁরা এ নিয়ে কেন মুখ খোলেননি!
বিএসএফ-এর ডিআইজি এস এস গুলেরিয়া রবিবার বলেন, ‘‘সংবেদনশীল বুথগুলির তালিকা আমাদের কাছে এখনও পর্যন্ত নেই।’’ বিএসএফ-কর্তার সংযোজন, ‘‘ওই তালিকা পেতে ৫ জুলাইয়ের পর থেকে বার বার চিঠি লেখা হয়েছে এবং যতগুলো বৈঠক (কমিশনের সঙ্গে) হয়েছে, প্রত্যেক বৈঠকেই আমরা ওই তালিকা চেয়ে অনুরোধ করেছি। কিন্তু তালিকা পাওয়া যায়নি।’’ কমিশন সূত্রের পাল্টা দাবি, সব তথ্যই দেওয়া হয়েছিল বাহিনী কর্তৃপক্ষকে। বিএসএফ-কর্তার দাবি, ‘‘বলা হয়েছিল, জেলাশাসক, পুলিশ সুপার বা পুলিশ কমিশনারেরা বলে দেবেন, কোথায় কোথায় বাহিনী মোতায়েন করতে হবে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা বাহিনীর যিনি সমন্বয় রক্ষা করছিলেন, তাঁকে স্পর্শকাতর বুথের তালিকা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তা পাওয়া যায়নি। যেখানে কেন্দ্রীয় বাহিনী ছিল, সেখানে মৃত্যু ঘটেনি।’’
বাহিনী-কর্তার দাবি, ভোটের দিন সকাল ১১টা পর্যন্ত ৬৪৯ কোম্পানির ৫৯ হাজার জওয়ান প্রস্তুত ছিলেন। ৬১,৬৩৬টি বুথের প্রতিটিতে বাহিনী দেওয়া সম্ভব ছিল না। ফলে অগ্রাধিকার ছিল স্পর্শকাতর বা সংবেদনশীল বুথের (৪৮৩৪) সুরক্ষা। সেই তথ্য বাহিনীকে জানতে হয়েছিল সংবাদমাধ্যমের থেকে। যদিও, তা জেনেও কিছু করার ছিল না তাঁদের। জেলাশাসক বা পুলিশ সুপারেরা যেখানে বলেছিলেন, সেখানেই বাহিনী মোতায়েন করতে হয়েছে। তার মধ্যে সমস্ত স্পর্শকাতর বুথ ছিল কি না, তা জানা নেই বাহিনীর কর্তাদের।
অভিযোগ, ভোট ঘোষণার পর থেকেই বাহিনী নিয়ে রীতিমতো গড়িমসি চলেছে কমিশনের তরফে। কেন্দ্রীয় বাহিনী ডাকা নিয়ে মামলা গড়িয়েছিল হাই কোর্ট, এমনকি সুপ্রিম কোর্টেও। শেষ পর্যন্ত আদালতের কাছে কার্যত ভর্ৎসিত হয়ে বাহিনী চাইতে বাধ্য হয়েছিল কমিশন। প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে বাহিনী মোতায়েন নিয়ে নির্দেশও দিয়েছিল আদালত। কিন্তু কোথায় কত বাহিনী যাবে, তা নিয়ে শুরু থেকেই অস্পষ্টতা ছিল কমিশনের অন্দরে। অভিযোগ উঠেছে, সর্বশেষ ৪৮৫ (মোট ৮২২ কোম্পানির মধ্যে) কোম্পানি বাহিনী পাঠানোর কথা ৩ জুলাই রাজ্যকে জানানো হলেও, তার মোতায়েন পরিকল্পনা কমিশন দেয় ৪ জুলাই রাতে। ফলে ৫ জুলাইয়ের আগে বাহিনীকে রাজ্যের উদ্দেশে রওনা করা সম্ভব হয়নি। আদালতের নির্দেশে গত ২২ জুনই ৪৮৫ কোম্পানি বাহিনী চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে চিঠি দিয়েছিল কমিশন। কেন্দ্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে একটি সূত্রের প্রশ্ন, তার পরেও সেই বাহিনী পাঠানোর কথা জানাতে ৩ জুলাই পর্যন্ত কেন অপেক্ষা করতে হল কেন্দ্রকে? বাহিনী সূত্রের দাবি, একসঙ্গে অত সংখ্যক বাহিনী জোগাড় করতে সময় লাগে। তা ছাড়া মণিপুর-সহ একাধিক রাজ্যে বিভিন্ন সমস্যা সামলানোর জন্য কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন রাখতে হয়েছে। সব পরিস্থিতি সামলে বাহিনী জোগাড়েও লেগেছে সমস্যা। তবে মোতায়েন পরিকল্পনা সঠিক সময়ে পাওয়া গেলে বাকি সমস্যাগুলি হতো না। কিন্তু ভোটের আগে কমিশনের এই ‘অসহযোগিতা’ নিয়ে কেন মুখ খোলেনি বাহিনী?
বাহিনী কর্তৃপক্ষের ব্যাখ্যা, পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে ভোট-নিরাপত্তার আয়োজন হওয়াটাই কাঙ্খিত। সেখানে দোষারোপ-পাল্টা দোষারোপ চললে মূল কাজটাই ব্যহত হয়। বাহিনী অত্যন্ত সুশৃঙ্খল এবং পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করে থাকে। ফলে কমিশনের সঙ্গে যত ভাবে সমন্বয় করা প্রয়োজন ছিল, সব করা হয়েছে। বিএসএফ-এর ডিআইজির বক্তব্য, ‘‘৫, ৬, ৭ এবং ৮ জুলাই স্পর্শকাতর বুথের সবিস্তার তালিকা চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছিল কমিশনকে।’’ যার সদুত্তর মেলেনি বলেই বাহিনীর দাবি।