সি ভি আনন্দ বোস (বাঁ দিকে) এবং ব্রাত্য বসু (ডান দিকে)। —ফাইল চিত্র।
রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে রাজ্যপাল একক ভাবে অন্তর্বর্তী উপাচার্য নিয়োগের পরে মাসকয়েক ধরে ‘তিক্ত’ রাজ্য-রাজ্যপাল সম্পর্ক। বিরোধ গড়িয়েছে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত। সেই আবহে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে দেওয়া রাজভবনের একটি চিঠি ঘিরে বিতর্ক দানা বেঁধেছে। নতুন করে তৈরি হয়েছে রাজ্য-রাজভবন সংঘাতের বাতাবরণ। রাজভবনের চিঠি নিয়ে অভিযোগ, সুপ্রিম কোর্টে রাজ্যের বিরুদ্ধে উপাচার্য নিয়োগ সংক্রান্ত মামলা লড়তে রাজ্যপাল তথা আচার্য সিভি আনন্দ বোস রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি থেকেই টাকা চাইছেন! বিশ্ববিদ্যালয়গুলি রাজভবনকে মামলার খরচ জোগালে প্রকারান্তরে সেই টাকা রাজ্যের কোষাগার থেকেই যাওয়ার কথা। এই যুক্তিতে রাজ্য কেন বোসকে মামলার খরচ দেবে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলির কাছে তা জানতে চেয়েছে উচ্চ শিক্ষা দফতর। শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুও বিষয়টি ‘জমিদারি’ প্রথার সঙ্গে তুলনা করেছেন। তাঁর মন্তব্য, ‘‘বিশ্ববিদ্যালয়গুলি আর যা-ই হোক, চাবুক চালিয়ে জমিদারি খাজনা আদায়ের তালুক হতে পারে না।’’ এ নিয়ে রাজভবনের তরফে সোমবার রাত পর্যন্ত কোনও বিবৃতি প্রকাশ্যে আসেনি।
বোস জমানায় শাসক তৃণমূলের সঙ্গে রাজভবন সংঘাতে ‘জমিদারি’ ব্যঞ্জনা আগেই যোগ হয়েছে। কেন্দ্রের কাছে রাজ্যের ‘বকেয়া’ আদায় নিয়ে গত অক্টোবর মাসে পথে নেমেছিল শাসকদল তৃণমূল। দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে দিল্লিতে দু’দিনব্যাপী কর্মসূচির পর কলকাতায় ‘কেন্দ্রের দূত’ রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করার দাবিতে রাজভবনের অদূরে ধর্না দিয়েছিল তৃণমূল। সেই সময় শহরে ছিলেন না বোস। ছিলেন উত্তরবঙ্গে। সেখান থেকে রাজ্যপাল জানিয়েছিলেন, তিনি শিলিগুড়িতে তৃণমূল নেতৃত্বের সঙ্গে দেখা করতে ইচ্ছুক। তার জন্য সময়ও বেঁধে দিয়েছিলেন তিনি। বিষয়টি এমন দাঁড়িয়েছিল যে, বোসের সঙ্গে দেখা করতে হলে ২-৩ ঘণ্টার মধ্যে কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি পৌঁছতে হত তৃণমূল নেতৃত্বকে। বিষয়টিকে সেই সময়ে ‘জমিদারি মানসিকতা’ বলে ব্যাখ্যা করেছিলেন অভিষেক। তার পর থেকে বেশ কয়েক বার রাজ্যপাল ও শাসকদলের মধ্যে বাগ্যুদ্ধে একে অপরের বিরুদ্ধে ‘জমিদারি’ কটাক্ষ চলেছে। এ বার রাজ্য-রাজভবন দ্বন্দ্বেও তার ছোঁয়াচ লাগল!
গত ১৭ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যদের উদ্দেশে রাজ্যপালের বিশেষ সচিবের স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, আচার্যের নির্দেশ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টে মামলা লড়ার ক্ষেত্রে আইনজীবীদের খরচ বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে ভাগাভাগি করে নিতে হবে। এবং তাদের মধ্যে সমন্বয়ের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে আর্থিক লেনদেনের ভার নিতে হবে। অভিযোগ উঠেছে, রাজ্যপালের সচিবালয়ের ওই চিঠিতে রাজ্যপাল বোসের নির্দেশের কথা বলে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে মামলার জন্য টাকা চাওয়া হচ্ছে। তার প্রেক্ষিতে সোমবার বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে চিঠি দিয়েছে উচ্চ শিক্ষা দফতর। পাঁচ দিনের মধ্যে তাদের কাছ থেকে জবাব চেয়ে পাঠানো হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলির কাছে বিকাশ ভবন জানতে চেয়েছে, উপাচার্য নিয়োগ মামলায় আচার্যের আইনজীবী বাবদ এখনও পর্যন্ত কত টাকা খরচ করেছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি? সেই খরচ কি সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ কমিটি ও রাজ্য সরকারের অনুমতি নিয়ে করা হয়েছে? বিকাশ ভবনের আরও প্রশ্ন, এই খরচ কি আদৌ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির বাজেট সংক্রান্ত নীতি মেনে হয়েছে?
বিকাশ ভবন সূত্রে খবর, রাজভবনের চিঠি পাওয়ার পর তহবিলও তৈরি করেছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি। কলকাতা, যাদবপুর-সহ বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে ইতিমধ্যেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি নির্দিষ্ট অ্যাকাউন্টে টাকা জমা পড়তে শুরু করেছে। এই বিষয়টি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে উচ্চ শিক্ষা দফতর। বিশ্ববিদ্যালয়গুলির কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে, কোন আইনে এই তহবিল গড়া হল? বিশ্ববিদ্যালয়গুলি আইনি খরচ বাবদ এখনও পর্যন্ত কত টাকা ওই তহবিলে ঢেলেছে? শুধু তা-ই নয়, যে সব আইনজীবীদের জন্য খরচ দেওয়া হচ্ছে, তাঁদের নাম আদৌ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির প্যানেলে রয়েছে কি না, তা-ও জানতে চেয়েছে বিকাশ ভবন।
ব্রাত্যও বলেন, “উচ্চ শিক্ষা বিভাগ জেনেছে, রাজভবন থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, আচার্যের হয়ে আইনজীবীরা মহামান্য সুপ্রিম কোর্টে দাঁড়াচ্ছেন, তাঁদের পারিশ্রমিক বাবদ খরচ বিভিন্ন সরকারপোষিত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তোলার জন্য। আইন অনুসারে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি এক মাত্র তাদের বাজেট অনুযায়ী অর্থ কমিটির সিদ্ধান্ত মেনেই যে কোনও খরচ করতে পারে। এই পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ শিক্ষা বিভাগ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে পাঁচ দিনের মধ্যে জানাতে বলা হয়েছে, এই ধরনের কোনও খরচ তারা দিয়েছে কি না! দেওয়া হয়ে থাকলে উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অনুমতি নেওয়া হয়েছে কি না এবং কোন বাজেটের কোন খাত থেকে অর্থ কমিটির কোন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এই টাকা দেওয়া হয়েছে।’’ বিশ্ববিদ্যালয়গুলি জবাব দিলে তার ভিত্তিতে ‘পশ্চিমবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯৭৬’ অনুযায়ী উচ্চ শিক্ষা বিভাগ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে বলেও জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী।
‘উপাচার্য’ মামলার খরচ রাজ্যপাল কেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলি থেকে নিচ্ছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে ইতিমধ্যেই সরব হয়েছে প্রাক্তন উপাচার্যদের মঞ্চ ‘পশ্চিমবঙ্গ এডুকেশনিস্টস ফোরাম ’। রাজভবনের চিঠির প্রেক্ষিতে তারা প্রশ্ন তুলেছে, কোন আইনি অধিকারের বলে রাজ্যপাল তথা আচার্য এমন ফরমান জারি করেছেন। এই নির্দেশ একই সঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের অবমাননা এবং বেআইনি ও অনৈতিক বলেও ওই মঞ্চ সরব হয়েছে। এডুকেশনিস্টস ফোরামের তরফে ওমপ্রকাশ মিশ্র, রঞ্জন চক্রবর্তী, আশুতোষ ঘোষদের প্রশ্ন, “রাজ্যের অনুদানপুষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকা কী ভাবে রাজ্যের বিরুদ্ধে মামলা লড়তে ব্যবহার করা হবে? এই অর্থের সংস্থান কি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিনান্স কমিটি বা সিন্ডিকেট বা এগ্জ়িকিউটিভ কাউন্সিলের অনুমোদন পেয়েছে? ২০১৭ সালের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী উচ্চ শিক্ষা দফতরের অনুমতিও কি নেওয়া হয়েছে?”
রাজ্যের জনগণের টাকায় রাজ্যের বিরুদ্ধে মামলা লড়া প্রসঙ্গে ব্রাত্য আগেই বলেছেন, “রাজ্যপাল তো মাছের তেলে মাছ ভাজতে চাইছেন।” বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হবে বলেও জানিয়েছিলেন তিনি।