Suvendu Adhikari

শুভেন্দুর আনন্দ-নিন্দায় চিন্তিত বিজেপি নেতৃত্ব, রাজভবনকে টানা টুইট-খোঁচায় অস্বস্তি দলে

রাজ্যপাল আনন্দ বোস তৃণমূলের প্রতি ‘পক্ষপাতদুষ্ট’ বলে আগেই কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে অভিযোগ জানিয়েছিলেন শুভেন্দু অধিকারী। তার পরেও নিয়মিত রাজ্যপালকে আক্রমণ করে চলেছেন বিরোধী দলনেতা।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৮:৫৮
Share:

আনন্দ নিয়ে অখুশি শুভেন্দু। — ফাইল চিত্র।

রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান নিয়ে বিতর্কে অখুশি ছিলেন না বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। বরং বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর সিদ্ধান্ত দলকে ‘রাজনৈতিক অস্ত্র’ দিয়েছে বলেই মনে করা হয়েছিল। ফলে শুভেন্দুর পথে হেঁটে সেই অনুষ্ঠান বয়কট করেছিলেন রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারও। কিন্তু সম্প্রতি একের পর এক টুইটে বা প্রকাশ্য জনসভায় শুভেন্দু একাই রাজ্যপালের সমালোচনা করে চলেছেন। দলের তরফে একমাত্র রাজ্যসভার প্রাক্তন সাংসদ স্বপন দাশগুপ্ত ছাড়া এখনও পর্যন্ত অন্য কোনও নেতা সেই সুরে সুর মেলাননি।

Advertisement

স্বপন ‘স্বতঃপ্রণোদিত’ হয়ে ওই সমালোচনা করেননি বলেই বিজেপির একটি সূত্রে দাবি করা হয়েছিল। স্বপন যতটা না ‘রাজনীতিক’, তার চেয়েও বেশি ‘তাত্ত্বিক’ বলেই পরিচিত। ফলে তাঁর কোনও মন্তব্য থেকে বিজেপির ‘দূরত্ব’ রচনারও একটা অবকাশ ছিল। কিন্তু স্বপনের পর শুভেন্দু ব্যতিরেকে আর কোনও নেতা রাজ্যপালকে আক্রমণ করেননি। বিজেপির একটি সূত্রে দাবি, বাকিরা যাতে তা না করেন, তেমনই নির্দেশ রয়েছে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের। যদিও আনুষ্ঠানিক ভাবে এর কোনও সত্যতা কেউই স্বীকার করেননি।

এ বিষয়ে বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারকে প্রশ্ন করা হলে তিনি শুভেন্দু প্রসঙ্গটি এড়িয়ে গিয়েছেন। তবে তাঁর বক্তব্যে এটা স্পষ্ট যে, তৃণমূলের সঙ্গে লড়াইয়ে তিনি রাজভবনকে ‘অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার করতে চান না। আনন্দবাজার অনলাইনকে সুকান্ত বলেন, ‘‘আমরা মনে করি, রাজনীতি ময়দানে নেমেই করতে হবে। তৃণমূলের সঙ্গে লড়াইয়ে রাজভবন কখনও অস্ত্র হতে পারে না। রাজ্যপাল সাংবিধানিক প্রধান। তাঁর সঙ্গে রাজনীতির দূরত্ব অনেক বলেই বিশ্বাস করে বিজেপি।’’

Advertisement

তবে বিজেপির একটি অংশের দাবি, তৃণমূলের সঙ্গে ‘ঘনিষ্ঠতা’ নিয়ে দিল্লি তাঁর সঙ্গে ইতিমধ্যেই কথা বলেছে। পদ্মশিবিরের ওই অংশের আরও বক্তব্য, আনন্দ বোসকে তাঁর মেয়াদ শেষের আগেই বাংলার রাজ্যপালের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে। তবে প্রত্যাশিত ভাবেই এই দাবির সত্যতা আনুষ্ঠানিক ভাবে কেউই স্বীকার করেননি।

জগদীপ ধনখড় উপরাষ্ট্রপতি পদের জন্য প্রার্থী হওয়ার পর থেকে বাংলায় রাজ্যপাল পদে স্থায়ী ভাবে কে আসবেন, তা নিয়ে অনেক জল্পনা তৈরি হয়েছিল। রাজ্য বিজেপি ধনখড়ের মতোই কাউকে চেয়েছিল। যাতে প্রধান বিরোধী দল হিসাবে শাসকদলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে রাজভবনের ‘মদত’ পাওয়া যায়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, নতুন রাজ্যপাল আনন্দ বোস ধনখড়ের উল্টো মেরুর বাসিন্দা। বিষয়টি বোঝার পর রাজ্য বিজেপির এক নেতা বলেছিলেন, ‘‘আমাদের ধনখড়-টু পাওয়ার আশা ছিল। কিন্তু মিলেছে উল্টোটা।’’ ধনখড় দৈনন্দিন রাজনীতি নিয়ে থাকতে ভালবাসতেন। সব বিষয়ে প্রকাশ্যে মতামতও জানাতেন। কিন্তু প্রাক্তন আমলা আনন্দ বোস সে সব থেকে অনেক দূরে। তিনি বরং বেশি করে সাংস্কৃতিক জগতের বাসিন্দা।

শুভেন্দুর মতোই রাজ্য বিজেপির অনেকের রাজ্যপালের বেশ কিছু পদক্ষেপ ও আচরণ নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে। কিন্তু বাকিরা তা নিয়ে নীরব আছেন। বার বার সরব হয়েছেন শুভেন্দু। রাজভবনে আসা ইস্তক রাজ্য প্রশাসনের সঙ্গে ‘সুসম্পর্কেরই’ ইঙ্গিত দিয়েছেন রাজ্যপাল। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে সরস্বতী পুজোর দিন বাংলায় হাতেখড়ি হয়েছে তাঁর। যে অনুষ্ঠানও ঘোষিত ভাবে বয়কট করেছিলেন শুভেন্দু। বয়কটের কারণ হিসাবে টুইট করে জানান, মনে হচ্ছে, এই অনুষ্ঠানের পরিকল্পনার মূলে রয়েছে রাজ্য সরকার। ঠিক যেন অশ্লীল কোনও বইকে ঝকঝকে মলাট দেওয়ার মতো কাজ করা হচ্ছে। তাই আমি মনে করি, বিকেল ৫টার অনুষ্ঠান রাজ্যপালের চেয়ার এবং রাজভবনের মর্যাদাকে বাড়াবে না।

রাজ্যপাল হিসাবে আনন্দ দায়িত্ব নেন গত বছরের ২৩ নভেম্বর। তার এক মাসের মধ্যেই কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে শুভেন্দু তাঁর বিরুদ্ধে অসন্তোষের কথা জানিয়েছিলেন। বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নড্ডার সঙ্গে বৈঠকে তিনি রাজ্যপাল ‘তৃণমূলের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট’ বলে মন্তব্য করেন বলে বিজেপির একটি সূত্রের বক্তব্য। ওই সূত্রের দাবি, নড্ডাকে শুভেন্দু এমনও বলেছিলেন যে, অতীতে তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে রাজ্যপালের দফতর থেকে যে ভাবে সাহায্য পাওয়া যেত, এখন আর তা পাওয়া যাচ্ছে না। তৃণমূলকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন নতুন রাজ্যপাল। শুভেন্দুর বক্তব্য শুনে নির্দিষ্ট কোনও মতামত না দিলেও বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ভাবনাচিন্তা করবেন বলেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন নড্ডা।

তবে শুভেন্দু তাঁর আক্রমণ জারি রেখেছেন। জানুয়ারি মাসে রাজভবনে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় রাজ্যপালের। সেই বৈঠক নিয়ে এগরায় দলীয় সভায় শুভেন্দু বলেন, ‘‘সংবিধানের রক্ষক হচ্ছে বিচারব্যবস্থা আর রাজভবন। রাজ্যের পীড়িত জনগণের মনে রাজ্যপালের স্বচ্ছ ভাবমূর্তি রয়েছে। তা নষ্ট করতে নাটক করা হয়েছে। রাজ্যপালের (বৈঠকে) থাকা উচিত ছিল না।’’ গত শনিবার ও সোমবারেও রাজ্যপালকে কটাক্ষ করে দু’টি টুইট করেছেন শুভেন্দু।

গত শনিবার রাজভবনে একটি অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করেন রুচিরা জৈন। ঘটনাচক্রে, তিনি রাজ্যের শিক্ষাসচিব মনীশ জৈনের স্ত্রী। সেই বিষয়েও টুইট করেন শুভেন্দু। রাজ্যপালকে অনুরোধ জানান, অন্য শিল্পীরাও যাতে সুযোগ পান। সোমবার সেন্ট জ়েভিয়ার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে মুখ্যমন্ত্রী মমতাকে সাম্মানিক ডি লিট প্রদান অনুষ্ঠানে রাজ্যপালের ভাষণ নিয়েও কটাক্ষ করেন শুভেন্দু। রাজ্যপাল আনন্দ বোস ওই অনুষ্ঠানে অটলবিহারী বাজপেয়ী, সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণন, উইনস্টন চার্চিল, এপিজে আব্দুল কালামের মতো ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মমতাকে এক বন্ধনীতে রেখে প্রশংসা করেছিলেন। এর পরেই টুইটারে শুভেন্দু লেখেন, ‘‘রাজ্যপালের ভাষণ শুনে মনে হচ্ছিল, যেন উনি রাজ্য বিধানসভায় বাজেট অধিবেশন শুরুর আগে যে ঔপচারিক বক্তৃতা দেবেন, তারই মহড়া দিলেন।’’

এখনও পর্যন্ত বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্ব এ নিয়ে শুভেন্দুকে কোনও বার্তা দিয়েছেন কি না জানা, তা কেউ বলতে পারছেন না। তবে এ বিষয়ে রাজ্যের সাংসদদের বার্তা দেওয়া হয়েছে বলে খবর। বিজেপির এক কেন্দ্রীয় নেতার কথায়, ‘‘আনন্দ বোসকে রাজ্যপাল হিসাবে বাংলায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন শীর্ষ নেতৃত্ব। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীরও সম্মতি ছিল। আনন্দ বোস তাঁর পছন্দের মানুষ। লাগাতার তাঁকে আক্রমণ করলে ভুল বার্তা যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়।’’

ধনখড় জমানায় তৃণমূল বার বার অভিযোগ তুলত, রাজভবন ‘বিজেপির পার্টি অফিস’ হয়ে গিয়েছে। রাজ্য রাজনীতিতে প্রাক্তন রাজ্যপালের ‘অতিসক্রিয়তা’ নিয়ে বিজেপিকে অনেক সময় অস্বস্তিকর সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। বার বার তার জবাবও দিতে হয়েছে। এখন আনন্দকে ‘তৃণমূল-ঘনিষ্ঠ’ বলা হলে দলের উল্টো অস্বস্তি তৈরি হবে বলেও অভিমত অনেকের।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement