অভিষেক ও সুমনের পাশে গঙ্গাপ্রসাদ। নিজস্ব চিত্র।
তৃণমূল প্রধান তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালীঘাটের বাড়ি একেবার আদিগঙ্গার পারে। সেই কালীঘাটের সঙ্গেই এখন ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ বিজেপির ‘আদি’ গঙ্গার। তাঁর হাত ধরেই রবিবার তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন আলিপুরদুয়ারের বিজেপি বিধায়ক সুমন কাঞ্জিলাল। তৃণমূল এবং বিজেপি— দুই শিবির সূত্রেই জানা গিয়েছে, এই যোগদানের নেপথ্যের ‘কারিগর’ গঙ্গা। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাধ্যমে সুমনের যোগদান পর্বে পাশে দাঁড়িয়ে করতালি দিতে ব্যস্ত গঙ্গাপ্রসাদ শর্মা।
সুমনের দলবদলে গেরুয়া শিবিরে অস্বস্তি তো আছেই! সেটা বিধানসভায় শক্তি কমে যাওয়ার অস্বস্তি। সেই হিসাব কষতে গেলে অবশ্য বিজেপির ঘর পোড়ার অভিজ্ঞতা নতুন নয়। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ৭৭টি আসনে জিতলেও কয়েক মাসের ব্যবধানে উপনির্বাচন পদ্মের শক্তি কমিয়ে ৭৫ করে দেয়। এর পরে মুকুল রায়কে দিয়ে বিধায়ক কমা শুরু। ২ মে ভোটের ফলপ্রকাশ। আর ১১ জুন পুত্র শুভ্রাংশু রায়কে নিয়ে মুকুল যোগদান করেন তৃণমূলে। সেই বছরেই অগস্টে বিষ্ণুপুরের তন্ময় ঘোষ এবং বাগদার বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাস বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে আসেন। এর পরে সেপ্টেম্বর কালিয়াগঞ্জের বিধায়ক সৌমেন রায়, অক্টোবরে রায়গঞ্জের বিধায়ক কৃষ্ণ কল্যাণী বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে যান। ২০২২ সালে আর বিধায়ক যোগ-বিয়োগ হয়নি। কিন্তু ২০২৩-এর শুরুতেই সুমনপর্ব।
আগের পাঁচ জন সকলেই তৃণমূল থেকে বিজেপিতে এসে আবার তৃণমূলে ফিরেছেন। কিন্তু সুমন তেমন নন। তিনি এক সময়ে কংগ্রেসের ছাত্র সংগঠনে ছিলেন বটে। কিন্তু তা নামমাত্র। সে অর্থে তাঁর ‘রাজনীতি’ বিজেপি থেকেই শুরু। সুমন বিজেপির আলিপুরদুয়ার সাংগঠনিক জেলার সাধারণ সম্পাদক হন। পরে বিধানসভা প্রার্থী এবং বিধায়ক। তবু সুমনের তৃণমূল যোগে ততটা চিন্তিত নয় বিজেপি। তাদের কপালে ভাঁজ গঙ্গাপ্রসাদকে নিয়ে।
গঙ্গাপ্রসাদ বিজেপির মূল সংগঠন আরএসএস (রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ)-এর আদি সদস্য। ছোটবেলা থেকে স্বয়ংসেবক। সঙ্ঘের প্রশিক্ষণের তিনটি পর্ব। তার সর্বোচ্চ তৃতীয় বর্ষ ‘প্রশিক্ষণ’। ২০০৬ সালে সেই পর্ব মিটিয়েছেন গঙ্গাপ্রসাদ। বিজেপি সূত্রে জানা যাচ্ছে, গঙ্গাপ্রসাদের সাংগঠনিক শক্তি দেখে তাঁকে রাজনীতিতে নিয়ে এসেছিলেন প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ। দায়িত্ব পেয়ে আলিপুরদুয়ারে বিজেপির শক্তি বাড়ানোয় বড় ভূমিকা নেন তিনি। পুরস্কারও পান। জেলা সভাপতি হয়ে যান খুব কম সময়ের মধ্যে। প্রতিদানও দিয়েছিলেন। ২০১৯ সালে আলিপুরদুয়ার লোকসভা আসনে জয়ের পিছনে ভগীরথের ভূমিকা ছিল গঙ্গার।
গঙ্গাপ্রসাদ শর্মা। আলিপুরদুয়ারে বিজেপির ভরসাই এখন তৃণমূলের সৈনিক। নিজস্ব চিত্র।
আলিপুরদুয়ার বিজেপির অন্দরে কান পাতলে শোনা যায়, দলের প্রতি খুবই অনুগত ছিলেন গঙ্গাপ্রসাদ। তাঁর নেতৃত্বেই সাংগঠনিক জেলার সাতটি বিধানসভার (তুফানগঞ্জ, কুমারগ্রাম, কালচিনি, আলিপুরদুয়ার, ফালাকাটা, মাদিরহাট, নাগরাকাটা) সব ক’টিতেই জয় পায় বিজেপি।
২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তাঁর দায়িত্বে থাকা এলাকায় গেরুয়া শিবির এত ভাল ফল করলেও সেই জয়ের অন্যতম কাণ্ডারি গঙ্গাপ্রসাদের দূরত্ব বেড়ে গিয়েছিল বিজেপির সঙ্গে। ফলপ্রকাশের পরে পরেই প্রায় নিঃশব্দে সরে যান তিনি। তৃণমূলে যোগ দেন এবং ২০২১ সালের অগস্ট মাসে ‘জয়গাঁ উন্নয়ন পর্ষদ’-এর চেয়ারম্যান হয়ে যান। সুমনকে বিজেপি থেকে নিয়ে এসে এ বার তিনি কি তৃণমূলকে ‘প্রতিদান’ দিলেন? আনন্দবাজার অনলাইনকে গঙ্গাপ্রসাদ বলেন, ‘‘না-না। এমন করে বলা ঠিক নয়। আমি একা কিছু নয়। এটা দলগত প্রয়াস ছিল। আমরা বলেছিলাম, ওখানে থেকে আর কী করবেন? আসুন, একসঙ্গে কাজ করি। তাতেই সাড়া দিয়েছেন উনি।’’
তবে বিজেপি শিবির এতটা সহজে মানছে না গঙ্গাপ্রসাদের যুক্তি। শীর্ষ নেতারা কেউ কিছু বলতে না চাইলেও রাজ্য স্তরের এক নেতার কথায়, ‘‘তৃতীয় বর্ষ প্রশিক্ষিত একজন স্বয়ংসেবক কার্যকর্তার থেকে এটা আশা করা যায় না। ব্যক্তিগত স্বার্থে ক্ষমতার লোভে তিনি নিজে গিয়েছেন। এ বার অন্তর্ঘাতের চেষ্টা চালাচ্ছেন। তবে এক জনকে টানতে পারলেও বেশি দূর এগোতে পারবেন না। বিজেপি ব্যক্তি নয়, সংগঠনকেই গুরুত্ব দেয়।’’
ওই রাজ্য নেতা এমন বললেও আলিপুরদুয়ারের বিজেপি নেতারা অশনি সংকেত দেখছেন সুমনের গঙ্গা-শরণে। কারণ, জেলায় যে এখনও গঙ্গার ‘প্রভাব’ রয়েছে, সেটা জানেন তাঁরা। সঙ্ঘের এক প্রবীণ প্রচারক গঙ্গাপ্রসাদ সম্পর্কে বলেন, ‘‘ক্ষোভ ছিল। তাই চলে গিয়েছেন। তবে পুরোপুরি আদর্শচ্যুত হয়েছেন বলা যাবে না। কিছু দিন আগেই ওঁর বাড়িতে গিয়েছিলাম। বসার ঘরেই ভারতমাতা, ডাক্তার’জি (সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠাতা), গুরু’জির (দ্বিতীয় প্রধান) ছবি দেখেছি।’’
গঙ্গাপ্রসাদকে বিজেপি ‘ঘরের শত্রু’ বলে আখ্যা দিতে চাইলেও গঙ্গা নিজে তা মানতে নারাজ। সঙ্ঘের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিয়ে তিনি বলেন, ‘‘আরএসএস কী, সেটা আমার চেয়ে বেশি কেউ জানে না। আরএসএস করেছি। সঙ্ঘের থেকে পাওয়া শিক্ষার জন্যই সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করছি। দেশের জন্য, সমাজের জন্য তখনও নিবেদিত ছিলাম। এখনও আছি। সংস্কার তো রয়ে গিয়েছে। সেটা সহজে চলে যায় না।’’
কিন্তু কেন ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল গঙ্গাপ্রসাদের? জেলার এক নেতা বলেন, ‘‘বিধানসভা নির্বাচনে দিল্লি থেকে প্রার্থী ঠিক করে দেওয়া পছন্দ ছিল না গঙ্গা’দার। পুরনো নেতাদের বাদ দিয়ে কেন দলে নবাগতরা এত গুরুত্ব পাচ্ছেন, তা নিয়েও ছিল আপত্তি। প্রতিবাদও করেছিলেন। কিন্তু তাতে কান দেওয়া হয়নি। তাতেই তিনি ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। তবে নির্বাচন পর্বে সেই ক্ষোভের আঁচ লাগতে দেননি। পরে নিজে থেকে সরে যান।’’
বিজেপি আলিপুরদুয়ার আসনে প্রথমে প্রার্থী হিসাবে অর্থনীতিবিদ অশোক লাহিড়ির নাম ঘোষণা করেছিল। পরে দেখা যায়, ভোটার তালিকায় নাম নেই অশোকের। তখন আলিপুরদুয়ারে মনোনয়ন জমা দেওয়ার আগে ভোটার তালিকায় নাম তোলার সময় ছিল না। ফলে অশোককে বালুরঘাটে প্রার্থী করা হয় এবং সুমনকে আলিপুরদুয়ারে।
আলিপুরদুয়ারের প্রার্থী নিয়ে বিজেপির অন্দরে অনেক জল্পনা তৈরি হয়েছিল। প্রথমে শোনা গিয়েছিল, সুব্রত চৌধুরী নামে একজনকে প্রার্থী করা হবে। তিনিও বিজেপিতে সুমনের মতোই ‘নব্য’ নেতা ছিলেন। অন্য দিকে, প্রার্থী হওয়ার ইচ্ছা ছিল স্বয়ং গঙ্গাপ্রসাদেরও। কিন্তু তখন রাজ্য বিজেপিতে শেষ কথা বলতেন পর্যবেক্ষক কৈলাস বিজয়বর্গীয়। তিনিই বেছে নেন সুমনকে। বিরোধিতা করেছিলেন গঙ্গাপ্রসাদ। বালুরঘাট থেকে অশোক এবং আলিপুরদুয়ার থেকে বিধায়ক হয়ে যান সুমন। যার জন্য গঙ্গাপ্রসাদের বিধানসভায় যাত্রাভঙ্গ হয়েছিল, সেই সুমনকেই তৃণমূলে এনে বিজেপির যাত্রাভঙ্গ করলেন গঙ্গাপ্রসাদ। এ সব কথা অবশ্য নিজমুখে বলছেন না তিনি। এর পরেও কেউ আছেন নাকি তাঁর তালিকায়? গঙ্গাপ্রসাদের উত্তর— ‘‘দেখা যাক! দেখুন না, কী কী হয়।’’ বিজেপিও দেখছে। এর পর কী কী হয় নিয়েই চিন্তা তাদের।