(বাঁ দিকে) মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিদ্যুৎ চক্রবর্তী (ডান দিকে)। —ফাইল চিত্র।
শান্তিনিকেতনকে বিশ্ব ঐতিহ্যক্ষেত্র বা ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ হিসাবে ইউনেস্কো স্বীকৃতি দেওয়ার পরে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ যে ফলকটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বসিয়েছেন, সেটিকে কেন্দ্র করে বিজেপি এবং তৃণমূলের বিরল ‘ঐক্য’ দেখা যাচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং ওই ফলকের বিরোধিতা করেছিলেন। তাঁর সুরেই সুর মিলিয়ে বিশ্বভারতীর উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তীকে আক্রমণ করতে শুরু করেছেন রাজ্যের বিজেপি নেতারা। রবিবার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর মুখে উপাচার্যের বিরোধিতা শোনা গিয়েছিল। সোমবার কড়া ভাষায় বিদ্যুতের সমালোচনা করলেন বিজেপির সর্বভারতীয় সম্পাদক তথা বীরভূমের নেতা অনুপম হাজরা।
সোমবার ফেসবুকে একটি পোস্ট করেছেন অনুপম। তাতে কবিতার আকারে বিশ্বভারতীর উপাচার্যের সমালোচনা করা হয়েছে। বিদ্যুৎ বিশ্বভারতীতে পৌষমেলা বন্ধ করেছেন, দোল খেলা বন্ধ করেছেন, প্রাক্তনী আশ্রমিকদের ‘পদাঘাত’ করেছেন বলে অভিযোগ অনুপমের। তিনি জানিয়েছেন, শান্তিনিকেতনের ভাবধারা আসলে বিদ্যুৎ কখনও বোঝেননি। তাঁর আমলে বিশ্বভারতীতে কবিগুরুর আদর্শ ‘চিৎপাত’ হয়েছে। বিদ্যুৎ কেবল ‘উপাচার্যের আরামকেদারা’কেই প্রাধান্য দিয়েছেন বলে দাবি অনুপমের। সব শেষে উপাচার্যের উদ্দেশে বিজেপি নেতার পরামর্শ, ‘‘নিঃস্বার্থ ভাবে কখনও রবি ঠাকুরকে ভালবেসো। এ বার তুমি দুগ্গা দুগ্গা করে এসো।’’ অর্থাৎ, উপাচার্যকে শান্তিনিকেতন ছাড়ার পরামর্শ দিয়েছেন অনুপম। উল্লেখ্য, তিনি নিজেও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী। সেখানে অধ্যাপনাও করেছেন। তবে নিজের পোস্টে কোথাও অনুপম বিদ্যুতের নামটি উল্লেখ করেননি।
প্রসঙ্গত, অমর্ত্য সেনকে নিয়ে বিতর্কের সময় থেকেই উপাচার্য বিদ্যুতের ‘বিজেপি-ঘেঁষা মনোভাব’ বিভিন্ন মহলে সমালোচনার ঝড় তুলেছিল। অনুপম তখনও বিদ্যুতের সমালোচনা করেছিলেন। তাঁর দাবি ছিল, উপাচার্য নিজেকে ‘বিজেপি’ বলে প্রমাণ করতে এ সব করছেন। সেই বিদ্যুৎকে নিশানা করেই ফের সমালোচনার সুর বিজেপির অনুপমের গলায়।
উপাচার্য বিদ্যুতের বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ, শান্তিনিকেতনকে বিশ্ব ঐতিহ্যক্ষেত্র হিসাবে ইউনেস্কো যে স্বীকৃতি দিয়েছে, উপাচার্য তার কৃতিত্ব নিতে চান। দেখা যায় বিশ্বভারতীর তরফে উপাসনাগৃহ, ছাতিমতলা এবং রবীন্দ্রভবনের উত্তরায়ণের সামনে শ্বেতপাথরের ফলক বসানো হয়েছে। তাতে লেখা, ‘ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’। তার ঠিক নীচে প্রধানমন্ত্রী তথা পদাধিকার বলে বিশ্বভারতীর আচার্য নরেন্দ্র মোদী এবং বিদ্যুতের নাম রয়েছে। কিন্তু কোথাও প্রতিষ্ঠাতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম নেই। সেখানেই বিতর্কের সূত্রপাত।
বিশ্বভারতীর ফলক বিতর্ক নিয়ে পুজো মিটতেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং উপাচার্য বিদ্যুৎকে আক্রমণ শুরু করেছিল তৃণমূল। একের পর এক শাসকদলের নেতানেত্রীরা সমাজমাধ্যমে কর্তৃপক্ষের নিন্দা করে পোস্ট করছিলেন। অবিলম্বে ফলকে রবি ঠাকুরের নাম ফিরিয়ে আনার দাবিও জানিয়েছিলেন তাঁরা। একই দিনে মমতা সাংবাদিক বৈঠকে ফলক বিতর্ক নিয়ে মুখ খোলেন। বিশ্বভারতীকে হুঁশিয়ারি দেওয়ার সুরে তিনি বলেন, ‘‘ওই ফলক না সরালে এবং রবি ঠাকুরের নাম ফিরিয়ে না আনলে ওখানে আমাদের লোক রবীন্দ্রনাথের ছবি বুকে নিয়ে আন্দোলন শুরু করবে।’’ মমতা বলেছিলেন, ‘‘বিশ্বভারতী ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পেয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্য। তিনিই প্রতিষ্ঠাতা। ওঁর নাম সরিয়ে দিয়েছে! পুজো বলে আমরা এটা চুপচাপ হজম করেছিলাম।’’ বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ তখন খানিকটা পিছু হটে জানান, ফলকটি ‘অস্থায়ী’। কিন্তু তাতে বিতর্ক থামেনি।
ফলক নিয়ে তৃণমূলের যখন এই অবস্থান, তখন বিজেপি কিন্তু উল্টো পথে হাঁটতে পারেনি। কারণ, রবি ঠাকুর বড় বালাই! তিনি শুধু বাংলার নন, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও তাঁর গুরুত্ব রয়েছে। তাঁর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলা এবং বাঙালির সংস্কৃতি, আবেগ। সেই আবেগের প্রসঙ্গ টেনেই রবিবার নন্দীগ্রামে একটি অনুষ্ঠানে বিদ্যুতের বিরোধিতা করেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দুও। তিনি বলেন, ‘‘এটা তৃণমূল বলেছে বলে আমি বলব না, তা তো হতে পারে না। ফলক নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। ভিসি (উপাচার্য বিদ্যুৎ) যদি এই ফলকটি করে থাকেন, তা হলে সংশোধন করুন। এটা নিয়ে ওঁর এত ইগোর কী আছে? এটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়। কতগুলি বিষয়ে বাংলা এবং বাঙালির ইমোশন (আবেগ) আছে, রেসপেক্ট (শ্রদ্ধা) আছে। তা হল নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, স্বামী বিবেকানন্দ এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁদের সম্মান করার বিষয়ে কোনও রকম জেদাজেদি থাকতে পারে না।’’ শুভেন্দুর এ ভাবে মমতার ‘পথে হাঁটা’ একেবারেই বিরল। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে শুভেন্দু বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর থেকে এমনটা কখনও ঘটেছে কি না, তা মনে করতে পারছেন না কেউ।
মমতার নির্দেশে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের ছবি বুকে নিয়ে ধর্না কর্মসূচি শুরু করে দিয়েছেন তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা। উপাচার্যের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি এবং রাজ্যপালের কাছে অভিযোগ জানিয়ে চিঠি দিয়েছে শান্তিনিকেতন ট্রাস্ট ও শান্তিনিকেতন আশ্রম সঙ্ঘ। একই ভাবে বিশ্বভারতী ইউনিভার্সিটি ফ্যাকাল্টি অ্যাসোসিয়েশনের (ভিবিইউএফএ) তরফেও প্রধানমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ও রাজ্যপালকে ই-মেল করে উপাচার্যের বিরুদ্ধে ফলক-কাণ্ড নিয়ে অভিযোগ জানানো হয়েছে। রাজভবন সূত্রের খবর, রাজ্যপাল বিষয়টি খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের কাছে কৈফিয়তও তলব করেছেন। যা অত্যন্ত ‘তাৎপর্যপূর্ণ’। কারণ, সাম্প্রতিক অতীতে নবান্ন এবং রাজভবনকে কথায়-কথায় পরস্পরের বিরুদ্ধে তাল ঠুকতে দেখা গিয়েছে। শিক্ষা থেকে আইনশৃঙ্খলা— নানা বিষয়ে প্রকাশ্যেই একে অপরের সমালোচনা করেছে নবান্ন এবং রাজভবন। কিন্তু ফলক-বিতর্কে মুখ্যমন্ত্রী মমতাকেই ‘সমর্থন’ করেছেন রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস।
ফলক বিতর্কে বিদ্যুৎ নিজেও অবশ্য চুপ করে বসে নেই। তিনি মুখ্যমন্ত্রীকে এ বিষয়ে একটি চিঠি দিয়েছেন। শনিবার এক্স হ্যান্ডেলে পোস্ট করে মমতা ফলক সরানোর বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। তার পরের দিনই বিদ্যুৎ চিঠিতে লেখেন, ‘‘আপনার স্তাবকেরা যা বলেন, আপনি তা-ই বিশ্বাস করেন। আপনি এখনও কান দিয়েই দেখেন!’’ মমতার প্রসঙ্গে আগেও এই মন্তব্য করেছেন বিদ্যুৎ। চিঠিতে তিনি জানান, ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ (এএসআই)-এর নির্দেশমতো ফলক তৈরি হচ্ছে। কিছু দিনের মধ্যেই তা সকলে দেখতে পাবেন। ফলক বিতর্কে বিজেপির অবস্থান বিদ্যুৎকে অস্বস্তিতে ফেলেছে বলে মনে করছেন অনেকে।